হাতে পবিত্র কোরআন লেখার গল্প বললেন তাসনিম

প্রাচ্যবাণী ডেস্ক
করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শুরু হয় ২০২০ সালের মার্চে। এরপর বাড়তে থাকে মৃত্যুর খবর। তখন পরিস্থিতি এমন ছিল যে কেউ মারা গেলে কাছেও যাওয়া যেত না।
গণমাধ্যম বা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এগুলো দেখতে দেখতে বিষণ্নতায় ভুগতে থাকেন জারিন তাসনিম (দিয়া)।
এসব থেকে দূরে থাকতে কিছু একটা করতে চান তাসনিম। ছোটবেলা থেকেই হাতের লেখা ভালো ছিল। হুট করেই সিদ্ধান্ত নেন পবিত্র কোরআন হাতে লিখবেন। শুরুও করে দেন লেখা। দেড় বছরের চেষ্টায় পুরো পবিত্র কোরআন হাতে লিখে শেষ করেন গত বছরের অক্টোবরে। হাফেজদের দিয়ে সংশোধন ও স্ক্যান করে ছাপানোর কাজও শেষ হয়েছে।
রাজধানীর ধানমন্ডিতে থাকেন জারিন তাসনিম। নিজের ঘরে হাতে লেখা পবিত্র কোরআনের বাঁধাই করা ৫০টি কপি রেখেছেন। দেখিয়ে বলেন, তিনি বিনা মূল্যে পবিত্র কোরআন বিভিন্ন মাদ্রাসা ও মসজিদে দিতে চান। পবিত্র কোরআনের ৫০টি কপি করার খরচ দিয়েছেন ব্যবসায়ী বাবা মো. সুলতানুল আলম। তবে তাসনিম কম করে হলেও ৫০০ কপি বিনা মূল্যে বিভিন্ন মাদ্রাসা ও মসজিদে দিতে চান। এই কাজে আর্থিক সহযোগিতায় কেউ এগিয়ে এলেই তা সম্ভব হবে। কেউ কেউ এ বিষয়ে যোগাযোগও করেছেন। অনেকে বিনা মূল্যে নেওয়ার জন্যও ফোন করেন।
জারিন তাসনিম বললেন, ‘আমি পবিত্র কোরআন হাতে লিখেছি নিজের ভালো লাগা থেকে। এই পবিত্র কোরআনের কপি আমি কখনোই বিক্রি করব না। তবে সবাইকে বিনা মূল্যে বা উপহার দেওয়াও সম্ভব নয়।’
জারিন তাসনিম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফলিত গণিত বিভাগ থেকে মাস্টার্স করেছেন। বললেন ছোটবেলায় অন্যরা যেভাবে বাড়িতে হুজুরের কাছে পবিত্র কোরআন পড়ে, তিনিও তাই পড়েছেন। তাসনিম মাদ্রাসায় পড়েননি। পবিত্র কোরআনের হাফেজও নন।
আমি ভাইরাল হওয়ার জন্য হাতে পবিত্র কোরআন লিখিনি। তবে এখন ভাবি, আমার এ কাজ দেখে অন্যরা অনুপ্রাণিত হতেও পারেন। আর হাতে লেখা পবিত্র কোরআনটি বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে দিতে চাই, যাতে আমি যখন থাকব না তখনো আমার এ কাজ মানুষের কাছে সংরক্ষিত থাকবে। পবিত্র কোরআনটি যদি কেউ পড়েন তবেই আমার কষ্ট সার্থক হবে। ধর্মীয়ভাবে বললে, এতে আমার সওয়াবও হবে।
পবিত্র কোরআন হাতে লেখা শেষ করে বাসার কাছের মাদ্রাসাসহ পরিচিত হাফেজিয়া মাদ্রাসার হুজুরদের কাছে বিষয়টি নিয়ে কথা বললে, তাঁরা প্রথমে বিশ্বাস করেননি যে সত্যি সত্যি পুরো পবিত্র কোরআন হাতে লিখেছেন এবং তা পড়া যাবে। জারিন তাসনিম তাঁদের তখন বাসায় এসে দেখে যেতে বলেন। বাসায় এসে তাঁরা তা দেখে জানান, পবিত্র কোরআন তো পড়া যাচ্ছে। তখন তাঁরাই হাতে লেখা পবিত্র কোরআনে কোনো ভুল আছে কি না, তা সংশোধনের পরামর্শ দেন। পরে রাজধানীর হাজারীবাগের একটি মাদ্রাসার ৩০ জন হাফেজ হাতে লেখা পবিত্র কোরআনের কোথায় কোথায় ভুল আছে, তা চিহ্নিত করে দেন। তাসনিম তা সংশোধন করে আবার তাঁদের কাছে পাঠান। এভাবে লেগে যায় প্রায় তিন মাস। মাদ্রাসার হাফেজেরা কাজটি করে দিয়েছেন বিনা মূল্যে।
মূল পবিত্র কোরআনের প্রতিটি অক্ষর আঙুল দিয়ে ধরে, দেখে লেখার বিষয়টি বেশ কষ্টকর ছিল বললেন জারিন তাসনিম। তবে লিখতে লিখতে তা নেশার মতো হয়ে গিয়েছিল। ৬৫১ পৃষ্ঠার এই পবিত্র কোরআনের পাণ্ডুলিপিগুলোও যত্ন করে রেখে দিয়েছেন জারিন তাসনিম।
জারিন তাসনিমের বাড়ি জামালপুরে। তাঁর আরেক বোন জেবা তাহসিন আইন বিষয়ে পড়ছেন। জারিন তাসনিম বললেন, শুরুতে তিনি যখন তাঁর বাবা ও মা রেখা পারভীনকে পবিত্র কোরআন হাতে লেখার কথা জানিয়েছিলেন, তখন তাঁরাও তা বিশ্বাস করতে পারেননি। একটি সুরা লিখে বাবাকে দেখালে তখন বাবা লেখা শুরু করতে বলেন। আর লিখতে লিখতে জারিন তাসনিম মাকে অনুরোধ করতেন লেখাটা পড়া যাচ্ছে কি না, তা নিয়ে মতামত দেওয়ার জন্য।
জারিন তাসনিম বললেন, ‘পরিকল্পনা করে যে লেখাটা শুরু করেছিলাম, তা নয়। নীলক্ষেত থেকে কাগজ-কলম কেনার পর বাসায় এসেও আবার ভেবেছি। তারপর মনে হয়েছে আগে শুরু তো করি। শেষ করতে না পারলে করব না।’
জারিন তাসনিমের কাছে হাতে লেখা কোরআন শরিফের ৫০ কপি রয়েছে
জারিন তাসনিমের কাছে হাতে লেখা কোরআন শরিফের ৫০ কপি রয়েছেছবি: মানসুরা হোসাইন
জারিন তাসনিম বললেন, ‘সুরা ফাতেহা লিখলাম, প্রথম দিকে লেখা ভালো বা মনের মতো হচ্ছিল না। এক পাতা লিখতেই ছয় ঘণ্টার বেশি সময় লেগে গিয়েছিল। পরে ভাবলাম, করোনায় তো সব বন্ধ, সারা দিন তো ঘরেই থাকি। লিখতে থাকি। এক পারা লিখতে এক মাসের মতো সময় লাগে। ১৫ পারা লেখা শেষ হলো। সারা দিনে যখন সময় পেয়েছি, তখনই লিখেছি। কোথাও গেলে মূল পবিত্র কোরআন আর কাগজ-কলম সঙ্গে করে নিয়ে গিয়েছি। আসলে লেখা শুরু করার পর আমি আর থামিনি। ২০ পারার বেশি লেখার পর লেখায় গতি আসে।’
বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সাবেক সদস্য ছিলেন জারিন তাসনিম। তিনি বর্তমানে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের তথ্য ও গবেষণা উপকমিটির সদস্য হিসেবে দায়িত্বপালন করছেন। বললেন, ‘অনেকেই বলেন, রাজনীতি করে আবার পবিত্র কোরআন লিখেছি। তাঁদের বলি, ধর্মের বিষয়টি আমার একান্তই নিজস্ব ব্যাপার। শালীনতা বজায় রাখা, মারামারি না করা, মিথ্যা কথা না বলা—এগুলো শুধু ইসলাম ধর্মে বলা হয়েছে, তা তো নয়। সব ধর্মেই এ বিষয়গুলোর প্রতি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। বন্যায় ত্রাণ দেওয়া বা যেকোনো সামাজিক কাজেও যোগ দিচ্ছি।’ বিসিএস পরীক্ষার প্রস্তুতির পাশাপাশি চাকরি খুঁজছেন জারিন তাসনিম।
জারিন তাসনিম বলেন, হাতে পবিত্র কোরআন লেখার জন্য অনেকে নেতিবাচক মন্তব্যও করেন। অনেকে সরাসরি বলেন, ভাইরাল হওয়ার জন্য তিনি এ কাজ করেছেন। জারিন তাসনিম বলেন,‘ আমি ভাইরাল হওয়ার জন্য হাতে পবিত্র কোরআন লিখিনি। তবে এখন ভাবি, আমার এ কাজ দেখে অন্যরা অনুপ্রাণিত হতেও পারেন। আর হাতে লেখা পবিত্র কোরআনটি বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে দিতে চাই, যাতে আমি যখন থাকব না তখনো আমার এ কাজ মানুষের কাছে সংরক্ষিত থাকবে। পবিত্র কোরআনটি যদি কেউ পড়েন তবেই আমার কষ্ট সার্থক হবে। ধর্মীয়ভাবে বললে, এতে আমার সওয়াবও হবে।’