সোনারগাঁও হোটেল, ঢাকা চট্টগ্রাম চার লেন, কর্মজীবনের শ্রেষ্ঠ কীর্তি পদ্মা সেতু

মুহাম্মাদ শফিউল্লাহ

এগিয়ে আসছে পদ্মা সেতু উদ্বোধনের মুহূর্ত। নয়দিন পর স্থলপথে রাজধানীর সঙ্গে নিরবচ্ছিন্নভাবে যুক্ত হচ্ছে দক্ষিণাঞ্চল। বেশকিছু মানুষ পর্দার আড়ালে থেকে প্রকল্পটির সফল বাস্তবায়নে ভূমিকা রেখেছেন। তাদের নিয়ে ধারাবাহিক আয়োজনের প্রথম পর্ব পদ্মা বহুমুখী সেতুর প্রকল্প পরিচালক মো. শফিকুল ইসলামকে নিয়ে

মো. শফিকুল ইসলামের প্রকৌশলী হিসেবে পেশাগত জীবনের শুরু সোনারগাঁও হোটেলের নির্মাণকাজে। সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদপ্তরে যোগদানের পর নিজ কর্মদক্ষতায় হয়ে উঠেছিলেন সরকারের সবচেয়ে আস্থাভাজন প্রকৌশলীদের একজন। পরিচালক হিসেবে ঢাকা-চট্টগ্রাম চার লেনের মতো বড় কয়েকটি প্রকল্পের নির্মাণকাজ তত্ত্বাবধানও করেছেন। তবে তার কর্মজীবনের সবচেয়ে বড় কীর্তি হিসেবে থেকে যাবে পদ্মা সেতুর নাম। প্রকল্পের ঠিকাদার নিয়োগ থেকে শুরু করে নির্মাণকাজ শেষ করে সেতু চালু হওয়া পর্যন্ত গোটা প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন হচ্ছে তার পরিচালনায়ই। সরকারি চাকরি থেকে অবসর নেয়ার সময় পেরোলেও সততা, অভিজ্ঞতা ও কর্মদক্ষতা বিবেচনায় অন্য বিকল্প না খুঁজে তার ওপরেই ভরসা রেখেছে সরকার।

বৃহদায়তনের অবকাঠামো নির্মাণ প্রকল্পগুলোয় ঠিকাদার নিয়োগ থেকে শুরু করে নির্মাণকাজ শেষ হওয়া পর্যন্ত এক পরিচালকের অধীনে প্রকল্প বাস্তবায়নের রেকর্ড বাংলাদেশে খুব কম। এক্ষেত্রে অন্যতম ব্যতিক্রম পদ্মা বহুমুখী সেতু নির্মাণ প্রকল্প। ২০১১ সালের নভেম্বরে তত্কালীন প্রকল্প পরিচালক রফিকুল ইসলামের স্থলাভিষিক্ত হন মো. শফিকুল ইসলাম। ২০১৩ সালেই অবসরে যাওয়ার কথা ছিল তার। এরপর আরো চার দফায় চুক্তির মেয়াদ বাড়িয়ে তাকে প্রকল্প পরিচালক হিসেবে রেখে দেয়া হয়। সর্বশেষ গত জানুয়ারিতে তার মেয়াদ বাড়িয়ে আগামী বছরের ৩০ জুন পর্যন্ত করা হয়।

সেতুটির নির্মাণকাজের তত্ত্বাবধান করতে গিয়ে অনেক বড় চ্যালেঞ্জ নিতে হয়েছে মো. শফিকুল ইসলামকে। তিনি বলেন, বড় প্রকল্পে চ্যালেঞ্জও বড়। চ্যালেঞ্জ যেকোনো জায়গায়ই থাকে, সেটা ছোট হোক বা বড় হোক। আমরা জানি সমস্যা হবে। সমস্যার সমাধানও করতে হবে। পদ্মা সেতুর পাইল স্থাপনের সময় আমাদের সমস্যার মধ্যে পড়তে হয়েছিল। হলি আর্টিজানে জঙ্গি হামলার কারণে কাজে বেগ পেতে হয়েছে। করোনা মহামারীর কারণেও আমাদের সমস্যায় পড়তে হয়েছে। নদীভাঙন থেকে শুরু করে পদ্মা নদীর স্বতন্ত্র স্বভাবের কারণে কাজে বেগ পেতে হয়েছে।

তবে এসব চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও সংশ্লিষ্ট সবার সহযোগিতায় বৃহৎ এ প্রকল্প শেষ করা সম্ভব হয়েছে বলে মনে করছেন তিনি। তিনি বলেন, যেকোনো কাজ শেষ করতে পারলে ভালো লাগবেই। মহান আল্লাহর অশেষ রহমতে আমরা সবার সহযোগিতা পেয়েছি। আমাদের একক কোনো কৃতিত্ব নেই। ভালো টিম পেয়েছিলাম। সরকারের সব দপ্তর থেকে শুরু করে অর্থ বিভাগ, কাস্টমস, বন্দর, মন্ত্রণালয়, মন্ত্রী ও প্রধানমন্ত্রী—সবার কাছ থেকেই সহযোগিতা পেয়েছি। যে সময় যার কাছেই গিয়েছি, সেখানে স্বতঃস্ফূর্তভাবে কাজ করে দিয়েছেন।

এটা সব প্রকল্পে পাওয়া যায় না। তবে পদ্মা সেতু প্রকল্পে আমরা তা পেয়েছি।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শুরুতে পদ্মা সেতু প্রকল্প নিয়ে দুর্নীতির অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে প্রথম প্রকল্প পরিচালক রফিকুল ইসলামকে সরিয়ে দেয় সরকার। ওই সময় সওজ অধিদপ্তরের তত্কালীন অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী মো. শফিকুল ইসলামকে তার জায়গায় প্রকল্প পরিচালকের দায়িত্ব দেয়া হয়। অভিজ্ঞতা, দক্ষতা ও সততার জন্য তিনি চাকরিজীবনের শুরু থেকেই অনেক আস্থার জায়গায় ছিলেন।

শফিকুল ইসলামের বাড়ি কুমিল্লার দাউদকান্দি উপজেলায়। ১৯৭০ সালে গৌরীপুর উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক শেষ করে ১৯৭২ সালে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক শেষ করেন। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল থেকে ডিগ্রি অর্জন শেষে ১৯৭৮ সালে প্রকৌশলী হিসেবে পেশাগত কাজ শুরু করেন। সে সময় সোনারগাঁও হোটেল নির্মাণের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তিনি। ১৯৭৯ সালে সওজ অধিদপ্তরে যোগদান করেন।

প্রকল্প সূত্রে জানা যায়, ঠিকাদারের সঙ্গে চুক্তি অনুযায়ী চলতি বছরে পদ্মা সেতুর কাজ শেষ হলেও প্রকল্পের মেয়াদ ধরা হয়েছে আগামী বছরের জুন পর্যন্ত। শেষ এক বছর রাখা হয়েছে ডিফেক্ট লায়াবিলিটি পিরিয়ড (ডিএলপি) হিসেবে। এ এক বছরে সেতুতে কোনো ত্রুটি দেখা দিলে তা ঠিকাদাররা নিজেদের টাকায় ঠিক করে দেবে। অন্যদিকে ঠিকাদারের কিছু পাওনা থাকলে সেটা মেটাবে প্রকল্প কর্তৃপক্ষ। প্রকল্প পরিচালকের নতুন চুক্তির ফলে তিনি প্রকল্পের শেষ দিন পর্যন্ত থাকছেন। পদ্মা সেতু প্রকল্পে নদীশাসনের কাজ আগামী বছরের জুনে শেষ হওয়ার কথা রয়েছে।

পদ্মা সেতু নির্মাণ প্রকল্পটি জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটিতে (একনেক) অনুমোদন হয়েছিল ২০০৭ সালের আগস্টে। ২০০৭-১৫ মেয়াদে বাস্তবায়নের লক্ষ্যে প্রকল্পটি অনুমোদন করেছিল তত্কালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার। নির্মাণ ব্যয় ধরা হয়েছিল ১০ হাজার ১৬১ কোটি টাকা। আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর ২০১১ সালে প্রকল্পটি প্রথমবার সংশোধন করা হয়। নকশা পরিবর্তন ও সেতুর সঙ্গে সংযোজন করা হয় রেলপথ। এতে প্রকল্পটির ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় ২০ হাজার ৫০৭ কোটি টাকা। মেয়াদ ২০১৫ সাল পর্যন্তই রাখা হয় প্রথম সংশোধনীতে।

পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্পের উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব (ডিপিপি) দ্বিতীয়বার সংশোধন করা হয় ২০১৬ সালের জানুয়ারিতে। নির্মাণ ব্যয় বাড়িয়ে ২৮ হাজার ৭৯৩ কোটি টাকায় উন্নীত করা হয়। মেয়াদ বাড়ানো হয় ২০১৮ সালের জুন পর্যন্ত। তবে ২০১৭ সালের দিকে সেতুর ১৪টি পিয়ারের (খুঁটি) নকশায় ত্রুটি দেখা দিলে বিলম্বিত হয় নির্মাণকাজ। নতুন করে নকশা করতে প্রায় ১৫ মাস অতিবাহিত হয়। এমন পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৮ সালের জুনে তৃতীয়বার ডিপিপিতে সংশোধন আনা হয়। এতে সেতুর ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি টাকা। মেয়াদ ধরা হয় ২০২১ সালের জুন পর্যন্ত। পরে করোনা মহামারীতে কাজে ধীরগতির কারণে পদ্মা সেতুর মেয়াদ ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত বাড়িয়ে নেয়া হয়।

Related Articles

Back to top button