সিন্ডিকেটের কব্জায় রডের বাজার

পাল্লা দিয়ে বেড়েছে সিমেন্টের দামও

নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রতি ব্যাগ সিমেন্টের দাম ৪০ থেকে ৫০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। রড ও সিমেন্টের দাম বৃদ্ধির কারণে সরকারি ও বেসরকারি উন্নয়ন কার্যক্রম স্বাভাবিক গতি ব্যাহত হচ্ছে। এ ব্যাপারে সরকারের সংশ্লিষ্টরা এক রকম নির্বিকার।

এক মাস আগেও টনপ্রতি ৬০ গ্রেডের রডের দাম ছিল ৭৪ থেকে ৭৫ হাজার টাকা। একই রড বর্তমানে বিক্রি হচ্ছে ৮৫ থেকে ৮৯ হাজার টাকা। রড উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো বলছে, ইউক্রেন ও রাশিয়া যুদ্ধ এবং বিশ্ববাজারে রড তৈরির কাঁচামালের দাম বৃদ্ধির কারণে রডের অস্বাভাবিক দাম বেড়েছে। তবে এটা মানতে নারাজ বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান, রিয়েল এস্টেট কোম্পানি ও ক্রেতারা। তারা বলছেন, আসন্ন বাজেটে রড উৎপাদনকারীরা সরকারের কাছে ভর্তুকি চায়। এজন্য সুকৌশলে রডের বাজারে অস্থিরতা ছড়াচ্ছে।

অবকাঠামো ও নির্মাণ খাতসংশ্লিষ্টরা বলছে, আমাদের দেশে একটি বাজে সংস্কৃতি রয়েছে। কোনো ঘটনা ঘটলে অসাধু চক্র তার সুবিধা নেওয়ার চেষ্টা করে। ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কথা বলে রডের দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত অযৌক্তিক। কেননা এসব রড তৈরির কাঁচামাল যুদ্ধের আগেই আনা হয়েছে। রড উৎপাদনকারীরা সম্পূর্ণ অযৌক্তিকভাবে দাম বাড়াচ্ছে। এ বিষয়ে সরকারের উচিত পদক্ষেপ গ্রহণ করা।

ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) হিসাব মতে, ভালো মানের বা ৬০ গ্রেডের রডের দাম এখন প্রায় ৮৯ হাজার টাকা। এক বছর আগে এসব রডের দাম ছিল ৭০ থেকে ৭১ হাজার টাকা। অর্থাৎ গত এক বছরে একই মানের রডের দাম বেড়েছে প্রায় ২৩ শতাংশ। আর ৪০ গ্রেডের রডের বর্তমান দাম ৭০ থেকে ৭৮ হাজার টাকা। এক বছর আগে এসব রডের দাম ছিল ৬২ থেকে ৬৬ হাজার টাকা। এ মানের রডের দাম বেড়েছে ১৬ শতাংশ। এর আগে রডের উচ্চমূল্য হয়েছিল ২০০৭ ও ২০০৮ সালে। সেবার টনপ্রতি রডের দাম ৮০ হাজার টাকা পর্যন্ত হয়েছিল। এরপর গত বছরের নভেম্বর টনপ্রতি রডের দাম ৮১ হাজার টাকা পর্যন্ত হয়েছিল। এবার সেসব দামও ছাড়িয়েছে।

এ প্রসঙ্গে রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (রিহ্যাব) সহসভাপতি কামাল মাহমুদ বলেন, রড উৎপাদনের সঙ্গে জড়িতরা সিন্ডিকেট করে দাম বাড়াচ্ছে। ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ এবং বিশ্ববাজারে রড উৎপাদনের কাঁচামালের দাম বৃদ্ধির যে কথা বলা হচ্ছে, সেটা সঠিক নয়। এখানকার মূল বিষয় হচ্ছে, রড উৎপাদনকারীরা এ খাতে ভর্তুকি চায়। আসন্ন বাজেটে তারা সেটা আদায় করতে চায়। এজন্য তারা রডের দাম বাড়িয়ে বাজার অস্থির করে তুলেছে।

তিনি বলেন, রডের দাম বৃদ্ধির কারণে আবাসন খাতসহ অন্যান্য নির্মাণ খাতের উন্নয়ন কাজ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এটা শুধু বেসরকারি খাতের সমস্যা বিষয়টি এমন নয়। এটা সরকারি বহু উন্নয়ন প্রকল্পের কাজও বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। বর্তমান সরকারের সময়ে দেশের সর্বত্র হাজার হাজার অবকাঠামো নির্মাণ প্রকল্প চলমান রয়েছে। এজন্য সার্বিক স্বার্থে রডের দাম বৃদ্ধির কারণগুলো চিহ্নিত করা দরকার। আমরা আশা করব, বাস্তব চিত্র বিশ্লেষণ করে রডের দাম বৃদ্ধির ব্যাপারে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় একটা ব্যাখ্যা দিক বা সংবাদ সম্মেলন করে জানাক।

তিনি আরও বলেন, গত এক সপ্তাহের ব্যবধানে সিমেন্টের দাম প্রতি ব্যাগে ৪০ থেকে ৫০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। এভাবে নির্মাণসামগ্রীর দাম বাড়লে কীভাবে কার্যক্রম পরিচালনা করব। বিষয়গুলো অবশ্য সরকারকে ভাবতে হবে। এ ব্যাপারে নির্দেশনা প্রদান করতে হবে। ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

এ প্রসঙ্গে গণপূর্ত অধিদপ্তর, সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর, স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর এবং সিটি করপোরেশনের তালিকাভুক্ত ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ‘মাইশা কনস্ট্রাকশন প্রাইভেট লিমিটেডের’ স্বত্বাধিকারী মো. পারভেজ বলেন, সরকারি সংস্থার নির্মাণসামগ্রীর মূল্য তালিকায় রডের টনপ্রতি দাম ধরা আছে ৫৫ হাজার থেকে ৬০ হাজার টাকা। বাস্তবে রডের টনপ্রতি দাম প্রায় ৯০ হাজার টাকা। এ অবস্থায় নির্মাণকাজ বন্ধ করে রেখেছি আমরা। সরকারের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে পরিপত্র জারি করে মূল্য তালিকায় রডের দাম বাজার মূল্য অনুযায়ী নির্ধারণ করা বা কাজের পরিধি কমিয়ে দেওয়া ছাড়া এসব কাজ করা কোনো ঠিকাদারের পক্ষে সম্ভব নয়।

তিনি বলেন, শুধু রড নয়, সিমেন্টের দাম লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। এক সপ্তাহের ব্যবধানে সিমেন্টের দাম প্রতি ব্যাগে বেড়েছে ৪০ থেকে ৫০ টাকা। এক সপ্তাহ আগে যে কোনো কোম্পানির এক ব্যাগ সিমেন্ট কেনা হয়েছে ৩৯০ টাকায়। এখন কিনতে হয়েছে ৪৫০ টাকায়। হঠাৎ করে সিমেন্টের দাম বৃদ্ধির কারণ কী। সরকারকে এ বিষয়গুলো খতিয়ে দেখে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ ও দিকনির্দেশনা প্রদানের দাবি জানাচ্ছি আমরা। এ ব্যাপারে সরকার এগিয়ে না এলে উন্নয়ন কাজের অগ্রগতি মুখ থুবড়ে পড়বে।

বাংলাদেশ শিপ ব্রেকার্স অ্যান্ড রিসাইক্লাস অ্যাসোসিয়েশন (বিএসবিআর) সূত্র জানায়, আন্তর্জাতিক বাজারে পুরোনো জাহাজের দাম অনেক বেড়ে গেছে। আগে টনপ্রতি পুরোনো জাহাজের দাম ছিল ৩৫০ থেকে ৪০০ ডলার। বর্তমানে সে দাম বেড়ে ৬০০ থেকে ৭০০ ডলার ছুঁয়েছে। এর সঙ্গে ভ্যাট-ট্যাক্স, কাটিংকসহ অন্যান্য খরচ। রডের দাম বৃদ্ধিতে প্রভাব পড়ছে এটাও।

বাংলাদেশ স্টিল ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন সূত্র জানায়, দেশে স্বয়ংক্রিয় ইস্পাত কারখানা রয়েছে ৩০টি। আর সনাতনী পদ্ধতির কারখানা রয়েছে প্রায় ১০০টি। দেশে বছরে রডের চাহিদা রয়েছে ৫০ থেকে ৫৫ লাখ টন। এ হিসাবে মাসে সাড়ে ৪ লাখ টন থেকে ৫ লাখ টন রডের প্রয়োজন হয়। এসব রড তৈরির জন্য কাঁচামাল হিসেবে পুরনো লোহার টুকরা আমদানি করা হয় ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ। বাকি ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ সংগ্রহ করা হয় জাহাজভাঙা শিল্প ও স্থানীয় ভাঙ্গারির বর্জ্য থেকে।

আরও জানা যায়, রডের দাম বৃদ্ধির কয়েকটি কারণ রয়েছে। আন্তর্জাতিক বাজারে কাঁচামালের দাম অনেক বেড়ে গেছে। প্রতি টন স্ক্র্যাপ কিছুদিন আগেও ৪৫০ ডলারে কেনা যেত। এখন সেটির এলসি দেওয়া হয়েছে ৬২০ ডলার করে। এছাড়া কারখানায় গ্যাস, বিদ্যুতের দাম বেড়েছে। শ্রমিকদের মজুরিও বৃদ্ধি পেয়েছে। দেশে উন্নয়ন কাজের জন্য রডের চাহিদা অনেক বেড়ে গেছে। তিন বছর আগে যদি প্রতিদিন ১০০ টন রড প্রয়োজন হতো এখন তা বেড়ে এক হাজার টনে দাঁড়িয়েছে।

বাংলাদেশ সিমেন্ট ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন সূত্র জানায়, সিমেন্ট তৈরির সব কাঁচামাল বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। করোনার পর থেকে জাহাজ ভাড়া বেড়েছে। আর ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে সিমেন্ট তৈরির কিছু কাঁচামালের দামও বেড়েছে। এ কারণে সিমেন্টের দাম বেড়েছে।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ স্টিল ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ও শাহরিয়ার স্টিল মিলসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শেখ মাসুদুল আলম মাসুদ সোমবার বলেন, ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে ইউরোপের অনেক দেশ ইউরোপ থেকে রডের কাঁচামাল ক্রয় করছে। আগে তারা এসব কাঁচামাল ক্রয় করত ইউক্রেন ও রাশিয়া থেকে। যুদ্ধের কারণে তারা ইউরোপ থেকে রডের কাঁচামাল ক্রয় করছে। এ কারণে রডের কাঁচামালের দাম বেড়ে গেছে। আর বাংলাদেশ সব সময় ইউরোপ থেকে রডের কাঁচামাল সংগ্রহ করে থাকে।

তিনি আরও বলেন, সিন্ডিকেট করে রডের দাম বাড়ানোর কোনো প্রশ্নই আসে না। বৈশ্বিক বাজারে দাম বাড়ার কারণেই মূলত রডের দাম বেড়েছে। এখানে আর কোনো উদ্দেশ্য নেই।

সূত্র : যুগান্তর

Related Articles

Back to top button