শ্রীলংকা সংকটঃ সমস্যাটা অনেক গুলো সমস্যার ফল

শ্রীলংকা সংকট সমস্যাটা ডলার সংকট নয়, রিজার্ভ প্রায় শূন্য আসলে তা না, সেটা হলো অনেকগুলো সমস্যার ফল।

বর্তমান অবস্থার জন্য অনেকগুলো সমস্যাই দায়ী এর মধ্যে নিম্নোক্ত সমস্যা গুলো অন্যতম –

  • ১. ক্রোনিজম
  • ২. রাষ্ট্র ক্ষমতাকে এক পরিবার কেন্দ্রীক ও কেন্দ্রীভূতকরণ
  • ৩. এক পরিবার নীতি ও স্বজনপ্রীতির সংস্কৃতি
  • ৪. ভুল কৃষিনীতি-ফরেন কারেন্সি রক্ষায় রাসায়নিক সার আমদানি নিষিদ্ধ করন এবং ১০০% জৈব সারের ব্যবহার- কৃষি উৎপাদন কমে যাওয়া ।
  • ৫. রপ্তানি পণ্যের ভঙ্গুর ভিত্তি – বিশেষ করে চায়ের উৎপাদন কমে যাওয়া ।
  • ৬. অত্যধিক মাত্রায় বিদেশি ঋণ গ্রহণ – অনেকগুলো মেগা প্রকল্প একসাথে গ্রহণ করুন ।
  • ৭. গোষ্ঠীতন্ত্র ও দুর্নীতি নিয়ে গণ উদ্বেগকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে উড়িয়ে দেওয়া এবং সমালোচনাকে সরকারের বিরুদ্ধে বিশ্বাসঘাতকতা আর সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র ও সাবোটাজ বলে অভিযোগ করা ।
  • ৮. অন্তর্মুখী শিল্পায়নের কৌশল এই সংকটের জন্য দায়ী
  • ৯. ২০১৯ এর শেষের দিকে হোটেল ও পর্যটন এলাকায় বোম্বিং পর্যটনে ধ্বস নামে
  • ১০. কোভিড-১৯ এর প্রভাব
  • ১১. ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের প্রভাব
  • ১২. বেহিসাবি ভাবে গভীর সমুদ্র বন্দর স্থাপন (হাম্বান্টোটা) এবং এর বিপরীতে ঋণ পরিশোধের শিডিউলের অব্যবস্থাপনা ।
  • ১৩. অপ্রয়োজনীয়ভাবে ব্যয়বহুল বিমান বন্দর স্থাপন
  • ১৪. গভীর সমুদ্র থেকে ভূমি বের করে আধুনিক সিটি নির্মাণ এবং এর বিপরীতে ঋণ পরিশোধের শিডিউলের অব্যবস্থাপনা
  • ১৫. বাবা- ছেলে – নাতি ৩ জেনারেশনই শীর্ষ ধনী এবং আত্মীয়-স্বজনসহ প্রত্যেকেই দুর্নীতিগ্রস্ত।
  • ১৬. ভরসা করার মতো যোগ্য বিরোধী দল না থাকা ।

দেহে অসুখের কারণ নির্ণয় করা গেলে তার সমাধান অনেকাংশেই সহজে হয়ে যায় ।

আমরা অনেকে চীনকে দোষারোপ করি যে, তাদের কারনে আজ শ্রীলঙ্কার এই অবস্থা ! এটা আমি সঠিক মনে করি না ! আপনি যখন কারো কাছ থেকে ঋণ নেবেন, সেই ঋণ কিভাবে পরিশোধ করবেন বা পরিশোধ করার ক্যাপাসিটি ও ক্যাপাবিলিটি আপনার আছে কিনা ? পেমেন্ট শিডিউল কবে থেকে শুরু হবে ? কখন ব্রেক ইভেন্টে যাবেন, কখন থেকে ইনকাম জেনারেট হবে ? কত দিনের মধ্যে তা পেমেন্ট করবেন ? তা আপনাকেই নির্ধারণ করতে হবে । যখন দুর্নীতির মাধ্যমে কোনো প্রজেক্ট গ্রহণ করা হয়, তখন তার নিজের অজান্তেই কিছু অধিকার অন্যদের জন্য ছেড়ে দেয়া হয় । এ ক্ষেত্রেও তাই হয়েছিল ।

রাষ্ট্রক্ষমতায় থেকে দুর্নীতির মাধ্যমে অর্থ উপার্জন করে তা বিদেশে পাচার করা হয়েছে । মাছের পচন শুরু হয় মাথা থেকে । শ্রীলঙ্কায় ক্ষমতার শীর্ষে থাকা সবাই দুর্নীতিগ্রস্ত, পরবর্তীতে তাদের আত্মীয়-স্বজন এবং প্রশাসন থেকে আরম্ভ করে অন্যান্যরা দুর্নীতিতে জড়িয়ে যায় । বর্তমান প্রধানমন্ত্রী এবং একসময়ের প্রধানমন্ত্রী বর্তমানে প্রেসিডেন্ট – তাদের বাবাও দেশের মন্ত্রী ছিলেন । তারা অনেক ভাইবোন ছিলেন, তাদের তখন এত টাকা পয়সা ছিল না, পড়াশোনা করার টাকা জোগাড় করাও তাদের জন্য কষ্টকর ছিল । অথচ আজ তারা দেশের শীর্ষ ধনী । নাতিও শীর্ষ ধনী । বাবা থেকে নাতি পর্যন্ত সবাই এবং তাদের আত্মীয় স্বজনসহ সবাই দুর্নীতিগ্রস্ত । তারা দেশের প্রতি ন্যূনতম দায়িত্ববোধের পরিচয় দেয়নি ।এমনকি তাদের দেশাত্মবোধেরও অভাব ছিল । যদিও এই পরিবার ও দলের মাধ্যমেই শ্রীলংকার বিচ্ছিন্নতাবাদীদের কে দমন করা হয়েছিল । সেজন্য এ জাতি তাদের কাছে কৃতজ্ঞ কিন্তু কৃতজ্ঞতার একটি সীমা থাকা উচিৎ !

এই সংকট থেকে উত্তরণে আমি মনে করি নিম্নোক্ত পদক্ষেপগুলো গ্রহণ করলে এই জাতি আবার ঘুরে দাঁড়াবে-

  • ১. সরকারি বিভিন্ন কর্মসূচি থেকে পর্যায়ক্রমে ভর্তুকি প্রত্যাহার
  • ২. অযাচিত উন্নয়ন ব্যয় কমিয়ে আনা এবং করের হার ও আওতা বাড়ানো
  • ৩. প্রেসিডেন্টের ক্ষমতার সংকোচিতকরন
  • ৪. সর্বদলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন (অন্তত দুই বছরের জন্য)
  • ৫. বর্তমানে দেশটির মূল্যস্ফীতিতে বিশ্বের তিন নং অবস্থানে রয়েছে(১ম-জিম্বাবুয়ে, ২য়- লেবানন)। মূল্যস্ফীতি কমাতে হবে।
  • ৬. এই অবস্থার জন্য যারা যারা দায়ী তাদেরকে আইনের আওতায় নিয়ে আসা এবং বিদেশে পাচারকৃত অর্থ খুব দ্রুত দেশে ফিরিয়ে আনা ।

ছোটবেলায় পড়তাম দক্ষিন এশিয়ায় শ্রীলঙ্কার শিক্ষিতের হার ১০০% এবং মাথাপিছু আয়ের দিক দিয়ে আমাদের চেয়ে অনেক এগিয়ে ।
এমনকি ২০২০ এর জানুয়ারিতে Covid-19 মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়ার আগ মুহূর্তে, আমি এবং আমার প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নিবার্হী কর্মকর্তা একটি আন্তর্জাতিক কনফারেন্সে অংশ গ্রহণ করি । তখন তাদের প্রধান তিনটি শহর সফর করেছিলাম । তাদের বিমানবন্দর এ ইমিগ্রেশন ফর্মালিটিস সম্পন্ন করার সময় এদের কতরকম জিজ্ঞাসাবাদ – আমরা শ্রীলঙ্কায় থেকে যাব কিনা তার নিশ্চয়তা চাচ্ছে । সেটা আমার খুবই ভালো লেগেছিল কিন্তু সেই দেশটির এখন এই ভংগুর অবস্থা!

তাদের বৈদেশিক আয়ের অন্যতম উৎস ছিল পর্যটন ॥ পর্যটন শিল্পের জন্য বিদেশী ভাষা হিসেবে ইংরেজি জানা খুবই দরকার । এই ক্ষেত্রে শ্রীলংকার শ্রমিক থেকে আরম্ভ করে সবার আন্তর্জাতিক ভাষা হিসেবে ইংরেজীর উপরে তাদের বিশাল দক্ষতা – সফরে গিয়ে তাই দেখেছি ।

শোনা যায়, ২০০৭ এ বাংলাদেশের সংকটময় পরিস্থিতিতে মইন-ইউ-আহমেদ এবং ফখরুদ্দিন আহমেদের তত্ত্বাবধায়ক সরকার এই শ্রীলঙ্কাকে মডেল হিসাবে নিয়েছিল বাংলাদেশকে সংকট থেকে উত্তরনে এবং আমাদের আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নয়নে শ্রীলঙ্কাকে রোল মডেল হিসেবে কাজে লাগানোর ব্যাপারে কাজ করছিল।অথচ দুর্নীতির কারণে আজ এই দেশটি দেওলিয়া প্রায়!
আমাদের কামনা এবং আশীর্বাদ থাকবে দেশটি অতি দ্রুত সঠিক ব্যবস্থাপনার অধীনে তার আগের অবস্থানে ফিরে যাবে। তবে সবার আগে দরকার এবং জনতারও চাওয়া সমগ্র রাজাপক্ষের পরিবারই শাসন ক্ষমতা থেকে বিদায় হোক।
এক্ষেত্রে আইএমএফ, ওয়ার্ল্ড ব্যাংক এবং দাতা সংস্থা সহ পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোকে এগিয়ে আসতে হবে – তাদের রাজনৈতিক সংস্কার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার জন্য এবং জরুরি ভিত্তিতে সাহায্য করার জন্য ।

উপরোক্ত লেখাটি একান্ত আমার ব্যক্তিগত অভিমত । ভুল হলে ক্ষমা মার্জনীয় ।

লেখকঃ মোহাম্মদ আমির হোসেন সরকার
পেশা:ব্যাংকার, এসভিপি এন্ড ম্যানেজার, মধুমতি ব্যাংক লিঃ, মতিঝিল শাখা

Related Articles

Back to top button