রাশান সাম্রাজ্যবাদের অবসান অতঃপর বিশ্বের যুদ্ধ যুদ্ধ খেলার অবসান করেছিলেন যে মহা মানব

মিখাইল গর্বাচেভ Union of Soviet Socialist Republics (USSR) এর মৃত্যু ঘটিয়ে আধুনিক বিশ্বের ইতিহাসে যেমন পরিবর্তন আনায়ন করেছিলেন তেমন পূর্ব ইওরোপের দেশগুলোকে (ইউক্রেন, জর্জিয়া, বেলারুশ, উজবেকিস্তান, আর্মেনিয়া, আজারবাইজান, কাজাখস্তান, কির্জিস্তান, মলডোভা, টার্কমিনিস্তান, তাজিকিস্তান, লাটভিয়া, লিথুনিয়া এবং এস্তোনিয়া) সোভিয়েট শাসনমুক্ত করে দিয়ে পশ্চিমা বিশ্বের প্রসংশা এবং অনেক রাশিয়ানদের কাছে তিরষ্কৃত হয়েছিলেন।
জনাব গর্বাচেভের যুগান্তকারী গ্লাসনস্ত (openness) বা উন্মুক্ততা এবং প্রেস্ত্রইকা ((restructuring) বা আধুনিকীকরন (পুনর্গঠন) সংস্কার কর্মসূচী তাঁর অনিচ্ছা সত্বেও হয়তো সোভিয়েট ইউনিয়নের সমাপ্তি এবং তাঁর নিজের ক্ষমতাচ্যূতি ঘটিয়েছে।
যখন বিশ্বের অনেকেই মনে করতে শুরু করেছিলেন দুই পরাশক্তির ঠাণ্ডাযুদ্ধের সহসাই অবসান হচ্ছেনা তখন গর্বাচেভের সংস্কার কর্মসূচী ঠাণ্ডাযুদ্ধের অবসান ঘটায়। সোভিয়েট ইউনিয়ন ভেঙ্গে যাওয়ার দায়ে তিনি নিজ দেশে ঘৃনা পেয়েই গত মঙ্গলবার ৯১ বছর বয়সে মৃত বরন করেন।
গর্বাচেভ ক্ষমতায় থাকাকালীন অধিকাংশ ক্ষেত্রেই শত্রুতা নয় শান্তি প্রতিষ্ঠাকেই গ্রহন করেছিলেন। তিনি জার্মান চ্যান্চেলর হেলমুট কোহল, বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী মার্গারেট থ্যাচার, ইউএস প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগানসহ সকল পশ্চিমা নেতৃত্বের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপন করেন। এমনকি মার্গারেট থ্যাচারের বানী প্রনিধানযোগ্য, “আমি গর্বাচেভকে পছন্দ করি। আমরা গর্বাচেভের সাথে এক সংগে কাজ করতে পারি।”
এরই মধ্যে সোভিয়েট ইউনিয়ন ভেঙ্গে গেলো এবং গর্বাচেভ পুরোপুরি গুরুত্বহীন হলেন।তিনি ১৯৮৫ সালে এই বৃহৎ ইউনিয়নের ক্ষমতা গ্রহন করেছিলেন এবং একই সাথে কমিউনিস্ট পার্টির জেনারেল সেক্রেটারী হয়েছিলেন।
কিন্তু গর্বাচেভ ১৯৮৫ থেকে ১৯৯১ সাল পর্যন্ত যতোই বিধিনিষেধ হাল্কা করলেন ততোই অধিকতর কট্টর পন্থী কমিউনিস্ট নেতা বোরিস ইয়েলতসিন গর্বাচেভের ক্ষমতার লাগাম হাল্কা করে দিলেন এবং গর্বাচেভ রাশিয়ার জন্য অপ্রাসঙ্গিক হলেন। গত দশক ধরে ক্রমশঃ স্বাস্থ্যগতভাবে ভংগুর গর্বাচেভের সাবেক কেজেবি এজেন্ট প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সাথে একটা কুয়াশাচ্ছন্ন সম্পর্ক ছিলো। রাশিয়ার রাজনীতির ঘড়ি উল্টো রথে পরিচালনা করে গনতন্ত্রের পথে আনায়নের জন্য পুতিন তাঁকে কঠিন সমালোচনা করেছেন।
গর্বাচেভ ৫৪ বছর বয়সে ক্রেমলিনের পুরনো আদর্শ বা ধারনার বিপরীতে চমকপ্রদ ধারনা নিয়ে এসেছিলেন। তাঁর বিদেশ নীতি বিশ্বে একটি নতুন অর্ডার তৈরী করেছিলো। ইওরোপের ম্যাপ পাল্টে গেলো। গর্বাচেভ ধারাবাহিকভাবে পশ্চিমের সাথে নিরস্ত্রীকরন চুক্তিতে সই করলেন। আফগানিস্তান থেকে রাশিয়ার সৈন্য প্রত্যাহার করলেন। পূর্ব ইওরোপের দেশগুলোতে মস্কোর কর্তৃত্ব হাল্কা করলেন।
রাশিয়ার ভেতরে তাঁর প্রেস্ত্রইকা এবং গ্লাসনস্ত কর্মসূচী একটি কম্পন তৈরী করলো যা’ অনেকটা ভূকম্পনের মতো। হাজার হাজার রাজবন্দী মুক্তি পেলেন। এসবের মধ্যে বিজ্ঞানী আন্দ্রে শাখারভও ছিলেন।
কিন্তু আকাশকোনে মেঘ ঘনিভূত হচ্ছিলো। ১৯৮৫ সালে মদ্যপ রাশিয়ানদের ক্রোনিক মদ্যপানের ওপর অভিযান পরিচালনাই মদপ্রিয় রাশিয়ানদেরকে গর্বাচেভের ওপর ক্ষেপিয়ে তোলে এবং গর্বাচেভের ওপর রাশিয়ানদের একটা দীর্ঘ মেয়াদে ঘৃনাও জন্ম নেয়।
রাশিয়ার অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক স্বাধীনতায় রাশিয়ানরা উৎসাহিত না হয়ে মাল্টি-এ্যাথনিক সোভিয়েট সাম্রাজ্যে বরং বিচ্ছিন্নতা তৈরী হলো। বাল্টিক রিপাবলিকস থেকে শুরু করে ককেশাস এবং সেন্ট্রাল এশিয়ায় স্বাধীনতা আন্দোলন এবং পারষ্পরিক ইন্টার-এ্যাথনিক দ্বন্দ্ব অদৃশ্য শক্তিমান সোভিয়েট ইউনিয়নের ক্ষমতার ভিত্ নাড়িয়ে দেয়। একই সাথে সোভিয়েট সাম্রাজ্যের অন্ধকার দিকগুলো বিশ্ববাসীর কাছে উন্মোচিত হয়।
১৯৮৯ সালে পূর্ব ইওরোপের কমিউনিস্ট সরকারগুলো সমাজতন্ত্র ছুঁড়ে ফেলে দেয় এবং বার্লিন ওয়াল ভেংগে গিয়ে দুই জার্মান এক হয়ে যায়। ১৯৯০ সালে গর্বাচেভ প্রথম এবং শেষ সোভিয়েট প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হোন; মাস না পেরোতেই কট্টরপন্থী কমিউনিস্টদের বিরোধিতার সম্মুখীন হোন। যদিও ১৯৯১ সালের আগস্টের ক্যূ ব্যর্থ হয়; কিন্তু যেহেতু এই ক্যূ বোরিস ইয়েলতসিন ব্যর্থ করে দেন সেহেতু তিনি বিজয়ী নায়ক হলেন এবং গর্বাচেভকে ক্রাইমিয়ার একটি রিসোর্টে গৃহবন্দী করা হয়।
সোভিয়েট ইনিয়নের সাথে সাথে গর্বাচেভের ক্ষমতারও অবসান ঘটলো। ২০১৬ সালে গর্বাচেভের ২৫ তম পদত্যাগ দিবসে সরকারী নিউজ পেপার রোজিসকাইয়া গেজেটে প্রকাশিত বিশেষ আর্টিকেলে গর্বাচেভ সোভিয়েট ইউনিয়নের পতনে তাঁর দায়িত্বের অংশটুকুন শিকার করেন। তিনি আরও লেখেন যে রাজনৈতিক নীতি অনুসরন করেই তবে তিনি সোভিয়েট ইউনিয়ন রক্ষার চেষ্টা করেছিলেন।
নিজ দেশে যখন গর্বাচেভ অনেকটা একঘরে তখন ১৯৯০ সালে গর্বাচেভের শান্তিতে নোবেল প্রাইজ উইন করা বিশ্বে আলোচনার ঝড় তৈরী করে। গর্বাচেভ ফাউন্ডেশন তৈরী হয়। ফাউন্ডেশনের তহবিলে লক্ষ লক্ষ ডলার জমা হয়। পরিবেশবাদীরা এই তহবিল ব্যবহারে উদ্যোগী হলেন। সবকিছুই আবার রাশিয়ার জন্য বিব্রতকর ছিলো।
সোভিয়েট ইউনিয়ন ভেঙ্গে যাওয়ার পর রাশিয়ার প্রথম প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হোন স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে ১৯৯১ সালে বোরিস ইয়েলতসিন। ইয়েলতসিন পশ্চিমা চাপে অনেকগুলো নিরস্ত্রীকরন চুক্তি স্বাক্ষর করেন। তিনি অর্থনৈতিক রিফর্ম করতে গিয়ে বরং রাশিয়াকে অর্থনৈতিক মন্দায় ফেলে। এই সময় রাশিয়ার তেলের মূল্য অনেক নীচে নেমে গিয়েছিলো। এই অবস্থায় ১৯৯৯ সালে ইয়েলতসিন পদত্যাগ করেন এবং কেজিবি এজেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ক্ষমতা গ্রহন করেন।
গর্বাচেভকে তখন অনেকটা ভেঙ্গে পড়তে দেখা যায়। পুতিনের আগমনই বলে দিচ্ছিলো বিশ্বব্যাপী রাশিয়া বিরোধিতার সম্মুখীন হবে।
২০১১ সালে গর্বাচেভ তার ৮০ তম জন্মবার্ষিকীতে বললেন রাশিয়ায় নকল গনতন্ত্র রয়েছে। কিন্তু ২০১৪ সালের শেষ দিকে আবার পুতিনের ক্রাইমিয়া পুনর্দখল সমর্থন করেন।
তবে ৮০ তম জন্মবার্ষিকীর পর গর্বাচেভকে আর পাবলিকলি তেমন দেখা যায়নি।
যখন ২০১৮ সালে ডোনাল্ড ট্রাম্প ১৯৮৭ সালে রোনাল্ড রিগান এবং গর্বাচেভের মধ্যে করা মধ্যম রেইন্জের নিউক্লিয়ার নিরস্ত্রীকরন চুক্তি থেকে সরে যাওয়ার ঘোষনা দিলেন গর্বাচেভ তখন উষ্মা প্রকাশ করেন। গর্বাচেভ তখন ভেদোমস্তি পেপারে ঠান্ডা যুদ্ধ পরবর্তী সকল অর্জন নষ্ট হচ্ছে বলে তাঁর মতামত ব্যক্ত করেন।
গর্বাচেভ লেখেন, “রাজনীতি কোনো সমরাস্ত্র নয়; রাজনীতি নিরাপত্তা সমস্যা সমাধানের প্রধান অস্ত্র। আমাদের অস্ত্র প্রতিযোগিতা থেকে পৃথিবীকে রক্ষার জন্য উদ্যাগ গ্রহন প্রয়োজন যা’ রাজনীতির কাজ। সংঘর্ষ কিম্বা শত্রুতা পথ নয়; বরং রাজনীতিই নিয়ামক।”