রাজধানীতে বাড়ছে দুর্ঘটনা :সড়কে বেপরোয়া ব্যাটারি চালিত রিকশা

শৃঙ্খলা ফেরানোর উদ্যোগ নিলেও বাস্তবায়নের ধীরগতির কারণে সুফল মিলছে না

নিজস্ব প্রতিবেদক
রাজধানীতে ব্যাটারিচালিত রিকশার বেপরোয়া চলাচলে দুর্ঘটনা বাড়ছে। এতে জীবন কেড়ে নেওয়ার মতো ঘটনাও ঘটছে। নগরীর সড়ক ও পরিবহণের শৃঙ্খলা ফেরানোর উদ্যোগ নিলেও বাস্তবায়নের ধীরগতির কারণে সুফল মিলছে না। এখনো এক সংস্থা অন্য সংস্থার ওপর দায় চাপিয়ে দায়িত্ব এড়ানোর চেষ্টা করছেন। সমন্বয়হীনতার এ অবস্থায় অকালে ঝরে যাচ্ছে অনেক প্রাণ। বর্তমানে রাজধানীতে প্রায় দুই লাখ ব্যাটারিচালিত রিকশায় যাত্রী পরিবহণ করছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানায়।

মঙ্গলবার মিরপুরে দুই মেয়েকে স্কুলে নিয়ে যাওয়ার পথে বাসের ধাক্কায় এক নারীর মৃত্যু হয়েছে। মিরপুর-১৪ নম্বরের ভাষানটেক নেভি মার্কেটের সামনে মঙ্গলবার দুপুর ১২টার দিকে এ দুর্ঘটনা ঘটে। ব্যাটারিচালিত রিকশাকে পেছন থেকে একটি বাস ধাক্কা দেয়। ব্যাটারিচালিত রিকশাটি বাসকে টপকে যাওয়ার চেষ্টা করছিল, এ অবস্থায় দুর্ঘটনা ঘটে বলে প্রত্যক্ষদর্শী সূত্রে জানা যায়।

তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, প্রায় প্রতিদিন রাজধানীতে ব্যাটারিচালিত রিকশার চালকদের বেপরোয়া চলাচলে প্রধান সড়ক ও অলিগলিতে দুর্ঘটনা ঘটছে। এতে হতাহতের ঘটনাও ঘটছে। কিছু কিছু ঘটনা আলোচনায় আসছে। বাকি অনেক ঘটনা জানতেও পারছে না মানুষ।

আরও জানা যায়, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) বর্তমান মেয়র দায়িত্ব গ্রহণের পরপর ডিএসসিসি এলাকার ব্যাটারিচালিত রিকশা তুলে দেওয়ার উদ্যোগ গ্রহণ করে। কিছুদিন অভিযানও পরিচালনা করে। নানামুখী সমালোচনার কারণে ডিএসসিসির এ উদ্যোগের গতি হ্রাস পেয়েছে। কালেভদ্রে অভিযান পরিচালিত হচ্ছে। দেদার মহানগরীর অলিগলি থেকে প্রধান সড়ক পর্যন্ত অবৈধ ব্যাটারিচালিত রিকশা দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনও (ডিএনসিসি) ব্যাটারিচালিত রিকশামুক্ত রাজধানী চায়। সে লক্ষ্যে পুলিশকে অবৈধ ব্যাটারিচালিত রিকশা অপসারণে বিভিন্ন সময় অনুরোধ জানিয়েছে। এছাড়া বাস রুট রেশনালাইজেশন কমিটির সভায়ও এ বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। সেখানে ব্যাটারিচালিত রিকশা অপসারণে ডিএনসিসির সম্মতি জানিয়েছে বলে জানা যায়।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, রাজধানীতে রিকশার সংখ্যা কত, এর সঠিক কোনো তথ্য কোনো সংস্থার কাছে নেই। ডিএসসিসি এলাকায় অবৈধ প্রায় ৪ লাখ রিকশা রয়েছে। ডিএনসিসি এলাকায়ও অবৈধ রিকশার সংখ্যা ৪ থেকে ৫ লাখ হবে বলে মনে করছেন ডিএনসিসি সংশ্লিষ্টরা। নতুন করে ঢাকায় যেসব রিকশা নামানো হচ্ছে, এর মধ্যে বড় একটি সংখ্যা ব্যাটারিচালিত। শারীরিক কষ্ট লাঘব করতে রিকশাচালকরা ব্যাটারিচালিত রিকশা চালাতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছে। এজন্য রিকশার মালিকরাও রিকশায় ব্যাটারি যুক্ত করছেন।

সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, ডিএসসিসির কদমতলী, শ্যামপুর, ডেমরা, যাত্রাবাড়ী, সবুজবাগ, মান্ডা, খিলগাঁও, রামপুরায় ব্যাটারিচালিত রিকশার সংখ্যা বেশি। আর ডিএনসিসির মিরপুর, পল্লবী, শাহআলী, উত্তরখান, দক্ষিণখান, তুরাগ, মানিকদী, মোহাম্মদপুর, বছিলা, ঢাকা উদ্যান এলাকায় ব্যাটারিচালিত রিকশার সংখ্যার বেশি। এ প্রসঙ্গে গণপরিবহণ বিশেষজ্ঞ ও বাস রুট রেশনালাইজেশন কমিটির সদস্য ড. সালাহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, ঢাকার গণপরিবহণব্যবস্থায় চরম বিশৃঙ্খলা চলছে। এটা নিয়ন্ত্রণে সরকার উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। যার কার্যক্রম চলমান রয়েছে। এটা সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করতে পারলে ব্যাটারিচালিত রিকশা, বাস, মিনিবাস ও অন্যান্য পরিবহণের বেপরোয়া চলাচল নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে। দুর্ঘটনার হারও কমে যাবে।

তিনি বলেন, অনুমোদিত যানবাহন রাজধানীতে চলাচল করছে। সঠিকভাবে এসব পরিবহণ পরিচালনা না করায় দুর্ঘটনা ঘটলে সেটা আলোচনা করা যায়। কিন্তু ব্যাটারিচালিত রিকশার তো কোনো বৈধতা নেই। এটা কীভাবে রাজধানীতে চলাচল করছে। এটা যাদের দেখার দরকার, তাদেরকে সঠিকভাবে এ কাজগুলো করতে হবে। তাহলে বিদ্যমান সমস্যার সমাধান হবে।

তিনি আরও বলেন, বাস রুট রেশনালাইজেশন কমিটির সভায় গণপরিবহণ ব্যবস্থাপনার সঙ্গে জড়িত সবাই উপস্থিত থাকেন। আগামী দিনে কমিটির সভায় আমি বিষয়টি উত্থাপন করব। এ সমস্যা নিয়ে আর চুপ করে থাকলে চলবে না। এর কার্যকর সমাধান করতে হবে। এ সম্পর্কে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সাধারণ সম্পাদক শেখ মুহাম্মদ মেহেদী আহসান বলেন, ব্যাটারিচালিত রিকশা রাজধানীর সড়কে সমস্যার সৃষ্টি করছে, এটা সঠিক। কেননা ঢাকায় তো রিকশার জন্য আলাদা লেন নেই। সব পরিবহণের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে এসব পরিবহণ চলাচল করে। আর এসব রিকশায় ব্যাটারি থাকার কারণে তারা প্রতিযোগিতা করে। এসব কারণে প্রায়ই দুর্ঘটনা ঘটছে।

তিনি বলেন, ব্যাটারিচালিত রিকশা অবৈধ। এটা সড়কে চলতে দেওয়া উচিত নয়। এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। তবে রাজধানীর সড়কে ম্যানুয়াল রিকশাগুলো তেমন কোনো সমস্যার সৃষ্টি করছে না। ম্যানুয়াল রিকশাগুলো সাধারণ মানুষের অপরিহার্য গণপরিবহণ। ব্যাটারিচালিত রিকশা উচ্ছেদ করতে গিয়ে ম্যানুয়াল রিকশা উঠিয়ে দিলে চলবে না। সড়কে শৃঙ্খলা আনতে কর্তৃপক্ষকে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।

জানতে চাইলে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ফরিদ আহাম্মদ বলেন, ব্যাটারিচালিত রিকশা অবৈধ। এটিকে সরকারি কোনো সংস্থার অনুমোদন দেওয়ার ক্ষমতা নেই। ডিএসসিসি এসব অবৈধ রিকশা উচ্ছেদে বিশেষ পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। এখনো এটি চলমান রয়েছে। পাশাপাশি ঢাকা মহানগর পুলিশকেও এ ব্যাপারে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে বলা হয়েছে। তিনি বলেন, ডিএসসিসি এলাকার অনুমোদিত রিকশার সংখ্যা খুবই কম। অনুমোদনহীন রিকশার সংখ্যা বেশি। রিকশার নৈরাজ্য নিরসনে ডিএসসিসি মেয়র বিশেষ পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন। ধারাবাহিক প্রক্রিয়ায় এ সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। একই বিষয়ে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা মোহাম্মদ আব্দুল হামিদ মিয়া বলেন, ব্যাটারিচালিত রিকশা অবৈধ। ডিএনসিসি থেকে এসব রিকশার অনুমোদন দেওয়ার কোনো ক্ষমতা নেই। ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার সময় ডিএনসিসি অবৈধ রিকশার বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা গ্রহণ করে থাকে। এসব অবৈধ রিকশা বন্ধে পুলিশেরও বড় ভূমিকা রয়েছে।

তিনি বলেন, ডিএনসিসি নগরীর রিকশার নৈরাজ্যের লাগাম টেনে ধরতে চায়। সে লক্ষ্যে বিশেষ কার্যক্রম গ্রহণ করবে। নতুন করে ডিএনসিসি কিছু রিকশার লাইসেন্সও প্রদান করবে। সে লক্ষ্যে কার্যক্রম চলমান রয়েছে। এ বিষয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশের যুগ্ম কমিশনার (দক্ষিণ) সৈয়দ নুরুল ইসলাম বলেন, ব্যাটারিচালিত রিকশার বিরুদ্ধে রুটিন অভিযান চলমান রয়েছে। ব্যাটারিচালিত রিকশা পেলেই তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। পুলিশের তৎপরতায় ব্যাটারিচালিত রিকশা অনেকাংশে কমে এসেছে বলেও দাবি তার। একই বিষয়ে জানতে ঢাকা মহানগর পুলিশের যুগ্মকমিশনার (উত্তর) আবু রায়হান মুহাম্মদ সালেহের নম্বরে একাধিকবার ফোন ও খুদে বার্তা (এসএমএস) পাঠানো হয়। এরপরও তিনি কোনো সাড়া দেননি।
সূত্র : যুগান্তর

Related Articles

Back to top button