মূলধন সংরক্ষণ করতে পারেনি ১১ ব্যাংক

নিজস্ব প্রতিবেদক
বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়া মহামারি করোনার কারণে বিগত এবং চলতি বছর অনেক সুবিধা দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ঋণখেলাপি না হওয়ার জন্য এতসব সুবিধা দিলেও তা গ্রহণ করার প্রবণতা লক্ষ করা যায়নি। এতসব ছা‌ড়ের পরও ঠেকানো যাচ্ছে না ঋণখেলাপির হার। ফলে মন্দ ঋণের বিপরীতে নিরাপত্তা সঞ্চিতি সংরক্ষণ করতে গিয়ে বড় আকারে মূলধন ঘাটতিতে পড়েছে সরকারি-বেসরকারি ১১টি ব্যাংক।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য মতে, চলতি বছরের সে‌প্টেম্বর শে‌ষে যে ১১টি ব্যাংক মূলধন সংরক্ষণে ব্যর্থ হয়েছে তার মধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত খাতের ৫টি, বিশেষায়িত খাতের দুটি ও বেসরকারি খাতের চারটি ব্যাংক রয়েছে।

মূলধন সঙ্কটে পড়া ব্যাংকগুলো হলো- রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংক, অগ্রণী ব্যাংক, বেসিক ব্যাংক, রূপালী ব্যাংক, জনতা ব্যাংক এবং বেসরকারি খাতের আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক, বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক, পদ্মা ব্যাংক ও এবি ব্যাংক। এ ছাড়াও রয়েছে বিশেষায়িত কৃষি ব্যাংক এবং রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক।

এসব ব্যাংকের মূলধন ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২৭ হাজার ৯১০ কোটি টাকা। তিন মাস আগে এসব ব্যাংকে ঘাট‌তি ছিল ২৫ হাজার ৩৮৫ কোটি টাকা।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গ্রাহকের আমানতের অর্থ থেকে ব্যাংকগুলো ঋণ প্রদান করে। সেই ঋণ খারাপ হয়ে পড়লে আইন অনুযায়ী নির্দিষ্ট হারে নিরাপত্তা সঞ্চিতি সংরক্ষণ করতে হয়। আবার খারাপ ঋণের ওপর অতিরিক্ত মূলধন রাখার বাধ্যবাধকতাও রয়েছে। কাক্সিক্ষত মুনাফা করতে না পারা ও লাগামহীন খেলাপি ঋণের কারণে দীর্ঘদিন ধরে বেশ কিছু ব্যাংক মূলধন সংরক্ষণ করতে পারছে না। ফলে মূলধন ঘাটতিতে পড়েছে।

আন্তর্জাতিক ব্যাংকিং রীতি ব্যাসেল-৩ অনুযায়ী ঝুঁকি বিবেচনায় ব্যাংকগুলোকে নিয়মিত মূলধন সংরক্ষণ করতে হয়। বর্তমান নিয়মে ব্যাংকগুলোকে ৪০০ কোটি টাকা অথবা ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদের ১০ শতাংশের মধ্যে যা বেশি সেই পরিমাণ অর্থ ন্যূনতম মূলধন হিসেবে সংরক্ষণ করতে হয়। এর বাইরে আপৎকালীন সুরক্ষা সঞ্চয় হিসেবে ব্যাংকগুলোকে ২০১৬ সাল থেকে অতিরিক্ত মূলধন রাখতে হচ্ছে।

যে ব্যাংকের খেলাপি ঋণ যত বেশি, ওই ব্যাংককে তত বেশি মূলধন রাখতে হয়। চলতি বছরের ৯ মাসে ব্যাংকগুলোতে খেলাপি ঋণ ১২ হাজার ৪১৬ কোটি টাকা বেড়ে ১ লাখ ১ হাজার ১৫০ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। এতে মূলধনের প্রয়োজনীয়তা বেড়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সে‌প্টেম্বর প্রান্তিকের তথ্য অনুযায়ী, সরকারি সাত ব্যাংকে বর্তমানে ঘাটতি রয়েছে ২৪ হাজার ২২১ কোটি টাকা। এর মধ্যে সর্বোচ্চ ১২ হাজার ১৪৪ কোটি টাকা ঘাটতি রয়েছে বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকে। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সোনালী ব্যাংকের ঘাট‌তি ২ হাজার ৬৩৩ কোটি টাকা। এ ছাড়া অগ্রণী ব্যাংকে ২ হাজার ৪৫৩ কোটি টাকা, বেসিক ব্যাংকের ২ হাজার ৩৫৩ কোটি, রূপালী ১ হাজার ৬৭৬ কোটি, রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন (রাকাব) ব্যাংক ১ হাজার ৫৪৩ কোটি এবং জনতা ব্যাংক ১ হাজার ৪১৬ কোটি টাকা ঘাটতি রয়েছে। বেসরকারি ব্যাংকগুলোর মধ্যে আইসিবি ইসলামিক ব্যাংকে ১ হাজার ৬৫২ কোটি টাকা, বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকে ১ হাজার ১৪৩ কোটি, পদ্মা ব্যাংকে ৫৪০ কোটি ও এবি ব্যাংকে ৩৫৫ কোটি টাকার মূলধন ঘাটতি রয়েছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, খেলাপি ঋণ আদায়ে ব্যাংকগুলোর বিশেষ কোনো উদ্যোগ নেই এবং এটা নিয়ে তারা উদ্বিগ্নও নয়। ব্যাংকের পর্ষদ ও ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে এক হয়ে গেছে, তারা খেলাপিদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না। এ ছাড়া শীর্ষ ঋণখেলাপিরা সবাই রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী। এ ছাড়া সরকারের তেমন সদিচ্ছারও দেখা নেই। যার কারণে খেলাপি ঋণ বাড়ছে।

তি‌নি জানান, নিয়ম অনুযায়ী খেলাপির বিপরীতে নিরাপত্তা সঞ্চিতি রাখতে গিয়ে মূলধন ঘাটতি‌তে প‌ড়ে‌ছে। সরকারি ব্যাংকগুলোতে এই হার বেশি। এর মূল কারণ এসব ব্যাংকে সুশাসনের অভাব। তাদের কোনো জবাবদিহিতা নেই। এখন ঘাটতি কমাতে হলে খেলা‌পি ঋণ আদায়ে জোর দিতে এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংক‌কে শক্ত হতে হবে বলে পরামর্শ দি‌য়ে‌ছেন সাবেক এই গভর্নর।

Related Articles

Back to top button