বৃক্ষরোপণ প্রকল্পে গাছের অস্তিত্ব নেই তবু বিল!
নাগেশ্বরী বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ

কুড়িগ্রাম প্রতিনিধি
কুড়িগ্রামে নাগেশ্বরীতে বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের আওতায় খননকৃত খালের দুই পাড়ে বৃক্ষরোপণ প্রকল্পে একটি আম গাছের চারা আড়াই শত এবং মেহগনির চারার ষাট টাকা মূল্য ধরা হয়েছে। অফিস পিয়নের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেওয়াসহ প্রকল্প স্থানে চারার অস্তিত্ব না থাকলেও ইতোমধ্যে ঠিকাদারকে বিল দিয়েছে সংশ্লিষ্ট বিভাগ। দুর্নীতির এ তুঘলকি কারবারে তোলপাড় শুরু হয়েছে।
সরেজমিন দেখা যায়, এশা ইন্টারপ্রাইজ তার কাজের এলাকা ১.৫ কিমি.জুড়ে এক হাজারের মতো চারা রোপণ করেছে। এর মধ্যে বেশির ভাগ গাছের চারা মরে শুকিয়ে গেছে। অপর দিকে ঠিকাদার তসলিমের প্রথম ২.৫ কিমি. এলাকায় ২ হাজার ৫০০টি ফলজ বৃক্ষ এবং পরবর্তী ২ কিমি. এলাকায় ১০ হাজার বনজ বৃক্ষের চারা রোপণের কথা থাকলেও কিছু মেহগনি ও আকাশমনি জাতের বনজ বৃক্ষের চারা রোপণ করেছেন। সব মিলিয়ে ২ হাজারের বেশি হবে না। এগুলোর বেশির ভাগ গাছ মরে গেছে। অপর দিকে ফলজ বলতে দু-একটি জাম ছাড়া অন্য কোন ফলজ বৃক্ষের অস্তিত্ব মেলেনি প্রকল্প এলাকায়।
বেরুবাড়ী সরকারপাড়া গ্রামের মোকাদ্দেস বলেন, এখানে গত বছর বন্যার আগে কয়েকজনকে কিছু গাছের চারা লাগাতে দেখেছি। তারপর আর কাউকে দেখিনি। এলাকাজুড়ে মেহগনি আর দু-একটা আকাশমনি ছাড়া অন্য গাছের চারা নেই। তার বেশির ভাগ চারা মরে গেছে। যেগুলো আছে সেগুলোও হবে না। মিরার ভিটা এলাকার আকবর আলী বলেন, এখানে ১০০ থেকে জামগাছ ছাড়া অন্য কোনো ফলের গাছ লাগানো হয়নি। যেগুলো লাগিয়েছিল সেগুলোও গরু ছাগলে খেয়ে নষ্ট করেছে।
তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, উপজেলার বেরুবাড়ী ইউনিয়নের বোয়ালের ডারা থেকে বেরুবাড়ী স্লুইস গেট পর্যন্ত বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন প্রকল্পের খননকৃত খালের দুই পাড়ে প্রায় সাড়ে বাইশ হাজার ফলজ, বনজ-ঔষধি বৃক্ষ রোপণ প্রকল্প বাস্তবায়িত্ব হচ্ছে। চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের ইআইআর প্রকল্পের অধীনে ৫ কিলোমিটার এলাকায় ১৮ লাখ টাকা ব্যয়ে এসব বৃক্ষ রোপণ করা হয়। এর মধ্যে ২০ হাজার বনজ এবং ২ হাজার ৫০০টি ফলজ। তিন ফুট উচ্চতার বনজ বৃক্ষের মধ্যে মেহগনি, আকাশমনি, শিমুল, কৃষ্ণচূড়া, জারুল, হরিতকি, বহেড়া, অর্জুন, আমলকী, দেশী নিম। পাঁচ ফুট উচ্চতার ফলজের মধ্যে আম (কলম), জাম, গোলাপজাম, জামরুল, পেয়ারা ও বাতাবি লেবু। প্রতিটি ফলজ বৃক্ষের চারার ২৫০ টাকা এবং বনজ চারার দাম ধরা হয়েছে ৬০ টাকা। এসব বৃক্ষ রোপণের কাজ পায় দুটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। একজন রাজশাহীর ঠিকাদার তসলিম, অপরজন খোদ নাগেশ্বরী বরেন্দ্র অফিসের পিয়ন এরশাদুল হক।
প্রকল্পের শুরুর স্থান বোয়ালের ডারা শূন্য মিটার থেকে ১৫০০ মিটার পর্যন্ত ১০ হাজার বনজ বৃক্ষ রোপণের কাজ পায় নাগেশ্বরী বরেন্দ্র অফিসের মাস্টার রোলে কর্মরত পিয়ন এরশাদুল হকের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ‘ইশা ইন্টারপ্রাইজ’। এ ছাড়া ১৫০০ মিটার থেকে ৪০০০ মিটার পর্যন্ত ২ হাজার ৫০০টি ফলজ বৃক্ষ এবং ৪০০০ মিটার থেকে ৬০০০ মিটার পর্যন্ত ১০ হাজার বনজ বৃক্ষ রোপণের কাজ পায় রাজশাহীর ঠিকাদার তসলিম। দরপত্রের শর্ত মোতাবেক ২০২১ সালের ১৫ আগস্টের মধ্যে বৃক্ষরোপণ শেষ করতে হবে এবং ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত রোপণকৃত চারার রক্ষণাবেক্ষণ করতে হবে এবং চারার পরিমাণ, দর ও জাত উল্লেখ করে সাইনবোর্ড দিতে হবে ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানকে।
চলতি বছরের ২৭ জানুয়ারি রোপণকৃত গাছের জরিপ করে বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ। জরিপে ইশা এন্টারপ্রাইজের রোপণকৃত ১০ হাজার গাছের মধ্যে ৭০৯০টি জীবিত গাছের বিপরীতে ৪ লাখ ২৫ হাজার ৪০০ টাকা বিল ধরা হয়। শতকরা ৫ ভাগ কমে প্রথম ধাপে (মোট বিলের অর্ধেক) চলতি বিল ২ লাখ ২০ হাজার ৬৫ টাকা পরিশোধ করে বরেন্দ্র কর্তৃপক্ষ। অপর দিকে ঠিকাদার তসলিমের ১০ হাজার বনজের মধ্যে জীবিত ৭১৩১টির বিপরীতে বিল ৪ লাখ ২৭ হাজার ৮৬০ টাকা ও ফলজ ২ হাজার ৫০০ মধ্যে জীবিত ১৭৮৩টির বিপরীতে বিল ৪ লাখ ৪৫ হাজার ৭৫০ টাকা ধরা হয়। তার মধ্যে চলতি বিল (মোটবিলের অর্ধেক) যথাক্রমে ২ লাখ ১৩ হাজার ৯৩০ টাকা ও ২ লাখ ২২ হাজার ৮৭৫ টাকা পরিশোধ করে কর্র্তৃপক্ষ।
ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান ইশা এন্টারপ্রাইজের মালিক ও নাগেশ্বরী বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ অফিসের পিয়ন এরশাদুল হক এক লাখ ৬১ হাজার টাকার বিল পাওয়ার কথা স্বীকার করে বলেন, তিনি নিজে গাছ রোপণ করেনি। উভয় ঠিকাদার কুড়িগ্রামের একজন নার্সারির মালিককে গাছ রোপণের দায়িত্ব দিয়েছেন। কি পরিমাণ গাছ রোপণ করা হয়েছে তা তার জানা নেই।
নাগেশ্বরী বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের উপসহকারী প্রকৌশলী খাইরুল বাশার রোপণকৃত গাছের কিছু অংশ বিভিন্ন উপায়ে নষ্ট হওয়ার দাবি করেন, চলতি বছর জুনের মধ্যে ৫০ ভাগের ওপর রোপণকৃত গাছের সংখ্যা না থাকলে ঠিকাদার বিল পাবে না। ইতোমধ্যে ঠিকাদারকে বিল পরিশোধের কথা অস্বীকার করেন তিনি।
এ বিষয়ে কুড়িগ্রাম বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন প্রকৌশলী আলমগীর কবির ঠিকাদারকে বিল দেওয়ার কথা স্বীকার করলেও বিস্তারিত তথ্যের জন্য প্রতিনিধিকে তথ্য অধিকার আইনে আবেদন দিয়ে মন্তব্য নেওয়ার পরামর্শ দেন।
সূত্র : যুগান্তর