বসন্তের রঙে রাঙিয়ে দিয়ে যাও

নুসরাত জাহান শুচি
সেইন্ট ভ্যালেন্টাইন্স ডে, যাকে অন্যভাবে সেইন্ট ভ্যালেন্টাইন্স উৎসবও বলা হয়; যা বর্তমান সময়ে “বিশ্ব ভালোবাসা দিবস” হিসেবেই সমাদ্রিত। বর্তমানে সমগ্র বিশ্বে দিনটিকে খুবই আনন্দের সঙ্গে ঘটা করে পালন করা হয়।
ভালোবাসা দিবসের ইতিহাসের দিকে তাকাতে গেলে আমরা বিভিন্ন দ্বিমত দেখেতে পাই। প্রাচীন রোমে ১৪ ফেব্রুয়ারি রোমান দেব-দেবীর রানী জুনোর (নারী ও প্রেমের দেবী) সম্মানে ছুটির দিন ঘোষণা করা হয়। কারো কারো মতে এটিকে ভালোবাসা দিবস বলার কারণ ছিল।
আবার কেউ বলেছেন, ২০০ খ্রিস্টাব্দে রোমের সম্রাট ক্লডিয়াস দেশে বিয়ে প্রথাকে নিষিদ্ধ করেন। তিনি ঘোষণা করে দেন- “আজ থেকে কোনো যুবক বিয়ে করতে পারবে না। যুবকদের জন্য শুধুই যুদ্ধ।” কেননা যুবকরা বিয়ে করলে যুদ্ধের প্রতি অনীহা করতে থাকে। তার মতে যুবকরা যদি বিয়ে করে তবে যুদ্ধ করবে কারা?
সম্রাটের এমন অন্যায় ঘোষণার প্রতিবাদ করেন ভ্যালেন্টাইন নামের এক যুবক। অসীম সাহসী এই যুবকের প্রতিবাদে ক্ষেপে উঠেছিলেন স্বয়ং সম্রাট। রাজদ্রোহের শাস্তি হিসেবে ১৪ ফেব্রুয়ারি ভোরবেলা মাথা কেটে ফেলে তার মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। ভালোবাসার জন্য ভ্যালেন্টাইনের আত্মত্যাগকে স্মরণ করতে তখন থেকেই এ দিনটিকে ভ্যালেন্টাইন দিবস হিসেবে পালন করা হয়।
আবার প্রাচীনকালে বিশ্বাস করা হতো ১৪ ফেব্রুয়ারি পাখিদের বিয়ের দিন। পাখিরা তাদের জীবন সাথীকে এদিনে বিয়ে করত। বসন্ত ঋতুটি যেন ছিল তাদের বিয়ের ও ভালোবাসার ঋতু। তাই ভালোবাসার এমন নিদর্শনকে পরবর্তীকালে ভালোবাসা দিবসের স্বীকৃতি দেওয়া হয়।
আবার এখানেও অনেকে দ্বিমত প্রকাশ করে বলেন, প্রাচীন রোমে ভ্যালেন্টাইন নামের একজন চিকিৎসক ছিলেন যিনি ভালোবেসে রোগীর সেবা করতেন এবং তেতো ওষুধের সাথে মধু ও দুধ মিশিয়ে রোগীদের খাওয়াতেন। একদিন রোমের এক কারাপ্রধান চিকিৎসার জন্য তার অন্ধ মেয়েকে ভ্যালেন্টাইনের কাছে নিয়ে এসেছিলেন।
ভ্যালেন্টাইন তার সাধ্যমতো চিকিৎসা করে মেয়েটিকে সুস্থ করে তোলার জন্য। মেয়েটির চিকিৎসা চলাকালীন হঠাৎ একদিন রোমান সৈন্যরা এসে ভ্যালেন্টাইনকে বেঁধে নিয়ে যায়। কেননা ডাক্তার ছিল খ্রিস্টান ধর্মের। সেই সময় এটি ছিল একটি অপরাধ।
যার শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। ভ্যালেন্টাইনের বুঝতে বাকি ছিল না খ্রিস্টান হওয়ার অপরাধে তাকে মেরে ফেলা হবে। ভ্যালেন্টাইন অন্ধ মেয়েটিকে বিদায় জানিয়ে একটি চিরকুট লিখে রেখে গিয়েছিলেন। তাতে লেখা ছিল— ‘ইতি তোমার ভ্যালেন্টাইন’ (‘From your Valentine’)।
ভ্যালেন্টাইনের হত্যার পর কারাপ্রধান চিরকুটটি মেয়েটিকে দিয়েছিলেন। মেয়েটি চিরকুটের ভেতরে বসন্তের হলুদ ত্রৌকস ফুলের আশ্চর্য সুন্দর রং দেখতে পেয়েছিল; কারণ ইতোমধ্যে ভ্যালেন্টাইনের চিকিৎসায় মেয়েটির অন্ধ দুই চোখে দৃষ্টি ফিরে এসেছিল। ২৬৯ খ্রিস্টাব্দে বা কারও মতে ২৭০ খ্রিস্টাব্দের ১৪ ফেব্রুয়ারি রোম সম্রাট ক্লডিয়াসের আদেশে ভ্যালেন্টাইনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। ভালোবাসার এসব কীর্তির জন্য ৪৯৬ খ্রিস্টাব্দে পোপ জেলাসিয়ুস ফেব্রুয়ারির ১৪ তারিখকে ভ্যালেন্টাইন্স ডে হিসেবে ঘোষণা করেন। সেই থেকেই দিনটিকে মানুষেরা ভ্যালেন্টাইন্স ডে হিসেবে পালন করা হয়ে আসছে।
তবে আজ থেকে কয়েক বছর আগে ও দিবসটি এত জনপ্রিয় ছিল না। দিবসটি কেবল যুক্তরাষ্ট্র ও পাশ্চাত্য সভ্যতার অংশ হিসেবে উদযাপন করা হতো; কিন্তু বর্তমানে দিনটি যেন পুরো বিশ্বে ভালোবাসা প্রকাশের একটি অন্যতম মধ্যমে পরিণত হয়েছে।
বাংলাদেশে সর্বপ্রথম যায়যায়দিন পত্রিকার সাংবাদিক এবং সম্পাদক শফিক রেহমান ১৯৯৩ সালে ভালোবাসা দিবস পালন করেন। লন্ডনে পড়ালেখা করার সময় পশ্চিমা সংস্কৃতির সংস্পর্শে আসেন তিনি। এরপর দেশের মানুষের মাঝে এই দিনটি তুলে ধরেন ভালোবাসার দিন হিসেবে।
বর্ণিল আয়োজনের মাধ্যমে আমাদের দেশে ভালোবাসা দিবস ও বসন্ত উৎসব উদযাপিত হয় পহেলা ফাল্গুনে। ভালোবাসার লাল রঙে রঙিন হয়ে ওঠে প্রকৃতি। চারিদিকে ফুল আর কোকিলের মধুর কন্ঠে গান যেন প্রকৃতিকে নতুন রূপে রাঙিয়ে তোলে।
প্রকৃতির এমন অপরূপ সৌন্দর্য যেন মানুষকে নতুন করে ভালোবাসতে শেখায়। চারেদিক থেকে বসন্তের গানই ভেসে ওঠে “বাতাসে বহিছে প্রেম, নয়নে লাগিলো নেশা, কারা যে ডাকিছে পিছে বসন্ত এসে গেছে”। এ বাতাসে যেন প্রেমের গন্ধ ভাসতে থাকে। রমণীরা লাল বা বাসন্তী শাড়ি আর মাথায় তাজা ফুল পরে বর্ণিল আয়োজনে বরণ করে বসন্ত কে।
তরুণ সমাজের কাছে বসন্ত পাশ্চাত্য সংস্কৃতি ও বাংলার নিজস্ব সংস্কৃতির মিশ্রণে ভিন্নভাবে “বিশ্ব ভালোবাসা দিবস” নামে এটি পালিত হয়। বসন্ত উৎসব ও ভালোবাসা দিবস শুধু প্রকৃতিকে নতুন করে সাজায় সেরকম না। বরং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, টিভি চ্যানেল গুলোতে প্রচারিত হয় বিভিন্ন ভালোবাসার গান, নাটক, গল্প ইত্যাদি।
ভালোবাসা দিবসের জনপ্রিয় নাটক “ক্লোজআপ কাছে আসার গল্প”; যা দর্শকরা লিখে পাঠান। তার মধ্যে মনোনীত করে সবচেয়ে সুন্দর গল্প নিয়ে বানানো হয় অসাধারণ ভালোবাসার তিনটি নাটক; যা এখনো জনপ্রিয়তার শীর্ষে। এছাড়া ফুলের দোকান, উপহার সামগ্রীর বিতান, শপিং মল ও রেস্তোরাঁগুলোতে থাকে বিভিন্ন অফার। কেবলমাত্র তরুণ সমাজই নয়, পরিবার ও বন্ধুবান্ধব সবাই মিলে উদযাপন করা হয় ভালোবাসা দিবস। ভালোবাসার এমন দিনে সবায় যেন কাছের মানুষটির সাথে ভালোবাসা ভাগাভাগি করে নিতে মরিয়া হয়ে ওঠেন।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ভালোবাসার এ উৎসব পালিত হয় বিভিন্নভাবে। বর্তমানে পাশ্চাত্যে ধুমধাম করে এ উৎসব উদ্যাপন করা হয়। যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্টে মানুষ প্রায় কোটি ডলার ব্যয় করে ভালোবাসা দিবসের জন্য কার্ড, ফুল, চকোলেট, অন্যান্য উপহারসামগ্রী ও শুভেচ্ছা কার্ড ক্রয় করে এবং আনুমানিক প্রায় ৩ কোটি শুভেচ্ছা কার্ড আদান-প্রদান করা হয়। তবে দিনটিকে সরকারি ছুটির দিন ঘোষণা করা হয়নি।
মহাসমারোহে ভালোবাসার উৎসব পালন করা হলেও বিভিন্ন দেশে ভ্যালেন্টাইন্স ডে’কে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। ১৭৭৬ সালে ফ্রান্স সরকার ভ্যালেন্টাইন্স উৎসব নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। কেননা পাশ্চাত্যের ক্ষেত্রে জন্মদিনের উৎসব, ধর্মোৎসব সবক্ষেত্রেই ভোগের বিষয়টি মুখ্য করে দেখা হয়। তাই গির্জার অভ্যন্তরেও মদ্যপানে তারা বিরত থাকে না। খ্রিস্টীয় চেতনা ভ্যালেন্টাইন দিবসের কারণে বিনষ্ট হওয়ার কারণেই ফ্রান্সে ভ্যালেন্টাইন্স ডে’কে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। ইংল্যান্ডের ক্ষমতাসীন পিউরিটানরাও প্রশাসনিক নিষিদ্ধ করেছিল ভ্যালেন্টাইন ডে। এছাড়া ও অস্ট্রিয়া, হাঙ্গেরি ও জার্মানিতে বিভিন্ন সময়ে এ দিবসটি জনগণ ও সরকারিভাবে প্রত্যাখ্যাত হয়েছিল।
২০০৯ সাল থেকে ইরানে ভালোবাসা দিবস উপলক্ষে ফুল, কার্ড, চকলেট ইত্যাদি দেওয়াকে নিষিদ্ধ করেছে। ইসলামী বিধানের পরিপন্থী হওয়ার ইন্দোনেশিয়া ও ভ্যালেন্টাইন ডে পালন নিষিদ্ধ করেছে। সর্বশেষ পাকিস্তানে ও দিনটি উদযাপনকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
ইসলামি শরীয়ত মোতাবেক ভ্যালেনটাইন্স ডে পালন করা গ্রহণযোগ্য নয়। তবে বর্তমানে ভ্যালেনটাইন্স আর বসন্ত উৎসব যেন মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। বাসন্তী আর লাল রঙে কেবল প্রকৃতিই নয় রঙিন হয়ে ওঠে প্রত্যেকটি মানুষের মন। বর্তমানে ভালোবাসা দিবস কেবল প্রেমিক প্রেমিকারা পালন করে এমন নয়। জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সব বয়সের মানুষ উদযাপন করে ভালোবাসার এ উৎসব। সবাই মিলে মেতে ওঠে ভালোবাসা আদান প্রদানের মাধ্যমে মনকে নতুন রঙে রাঙাতে। সবাই যেন নিজের অজান্তেই গেয়ে ওঠে—
“রাঙিয়ে দিয়ে যাও
যাও গো এবার যাবার আগে।”
নুসরাত জাহান শুচি
শিক্ষার্থী জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ