প্রযুক্তির ছোঁয়ায় বিলুপ্তপ্রায় হালখাতা

নিজস্ব প্রতিবেদক, রংপুর
বাংলা নববর্ষের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ হালখাতা। বাঙালি সংস্কৃতির ঐতিহ্য অনুযায়ী হালখাতা উপলক্ষে ব্যবসায়ীরা পুরনো হিসাব চুকিয়ে হালনাগাদ হিসাবের নতুন খাতা খুলতেন। এজন্য আগেই ক্রেতাদের নিমন্ত্রণ জানানো হতো রঙ-বেরঙের নানা কার্ড ছাপিয়ে। আর পয়লা বৈশাখে মিষ্টিমুখ করিয়ে তাদের বকেয়া হিসাব চুকিয়ে ফেলা হতো।

কিন্তু কালের বিবর্তনে বাংলা নববর্ষের হাত ধরে চলা পুরোনো ঐতিহ্য এই হালখাতা উৎসব আর হয় না বললেই চলে। আধুনিকায়নের নতুন এই সময়ে বদলে গেছে অনেক কিছু, বদলে গেছে পুরনো ধারা। তাই আগের মতো এখন সাড়া নেই হালখাতায়।

কাগুজে খাতার পরিবর্তে এখন কম্পিউটারেই সংরক্ষণ হচ্ছে হিসাব-নিকাশ। জাবেদা খাতা, খতিয়ান খাতার পরিবর্তে মাইক্রোসফট ওয়ার্ড কিংবা এক্সেল ব্যবহার করছেন ব্যবসায়ীরা।

jagonews24

আবার অনেকেই নতুন লালখাতা খুলে পুরাতন বছরের হালখাতার কাজ শেষ করে ফেলেন। গ্রামাঞ্চলের কিছু ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে এর প্রচলন চোখে পড়লেও শহর এলাকায় তা বিলুপ্তপ্রায়। আবার হালখাতা অনুষ্ঠিত হলেও তার নির্দিষ্ট কোনো সময়সীমাও থাকছে না। অনেকেই ধান কাটা-মাড়াই মৌসুমেই হালখাতার আয়োজন সেরে ফেলেন। অথচ চৈত্রের শেষ দিন ও পহেলা বৈশাখ ঘিরে এক সময়ের এই চিরচেনা প্রচলন যেন আজ হারিয়ে যেতে বসেছে।

ইতিহাস থেকে জানা যায়, প্রজাদের কাছ থেকে খাজনা আদায় সহজ করতে মোঘল সম্রাট আকবর চালু করেছিলেন বাংলা সন। বাংলা মাস চৈত্রের শেষ দিনে খাজনা আদায় আর বৈশাখের প্রথম দিনে মিষ্টি বিতরণের রেওয়াজ চালু করেন তিনি। কালের পরিক্রমায় যা পরিণত হয় বাঙালি ঐতিহ্যে।

জমিদারি প্রথা বিলুপ্তির পর ব্যবসায়িক হিসাব-নিকাশ মেটাতেও বেছে নেওয়া হয় এ দিনটিকেই। বনেদি থেকে খুদে ব্যবসায়ীরা তাদের ব্যবসায়িক হিসাব-নিকাশের জন্য চৈত্রের শেষ দিনে চালু করেন হালখাতা উৎসব।

রংপুর নগরীর নিউ ক্রস রোডের ইরা প্রিন্টিং প্রেসের মালিক আবু নাসের বাপ্পী বলেন, কয়েক যুগ আগেও বাহারি সব অনুষঙ্গে উদযাপিত হতো হালখাতা। পুরোনো বছরের হিসাব চুকিয়ে গ্রাহককে মিষ্টিমুখ করাতেন ব্যবসায়ীরা। আর লালখাতা খুলে বছরের প্রথম দিন হিসাব শুরু করতেন। কিন্তু কালের বিবর্তনে বাংলা নববর্ষের হাত ধরে চলা এই হালখাতা পুরোনো ঐতিহ্য হারাতে বসেছে। হালখাতা উৎসব আর হয় না বললেই চলে।

গঙ্গাচড়া উপজেলার বেতগাড়ি হাটের প্রবীণ ব্যবসায়ী মোসলেম উদ্দিন বলেন, চার দশক আগেও সারাদিন ও রাতভর মাইক বাজিয়ে সাজ সাজ রবে যে হালখাতার আয়োজন হতো এখন তা হয় না। দোকানে বাকি পড়লেও ফোনে জানিয়ে দেওয়া হয়। মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে বকেয়া পরিশোধ করেন ব্যবসায়ীরা। ফলে হালখাতা বা মিষ্টিমুখ করানোর প্রয়োজন হয় না।

রংপুর সিটি বাজারের ব্যবসায়ী আব্দুস সালাম বলেন, এখন সব ধরনের ব্যবসার প্রসার লাভ করেছে। প্রত্যন্ত অঞ্চলেও ছড়িয়ে পড়ছে সব ধরনের ব্যবসা। এ কারণে দোকানে আগের মতো বকেয়া পড়ে না । আর পড়লেও তা নির্দিষ্ট সময়ে পরিশোধ করেন ব্যবসায়ীরা। যদি কিছু বকেয়া থাকে তার জন্য অনুষ্ঠানের আয়োজন করার প্রয়োজন হয় না।

রংপুরের সিনিয়র সাহিত্যিক মাহবুবুল ইসলাম বলেন, এই দিনটি ঘিরে বাঙালির ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিতে হালখাতার যে প্রচলন তা অন্য কোনো দেশে বা সংস্কৃতিতে চোখে পড়ে না। কিন্তু আধুনিকতার ছোঁয়ায় হারিয়ে যেতে বসেছে এই সংস্কৃতি। গ্রামাঞ্চলে এখনও কিছু কিছু জায়গায় হালখাতার আয়োজন হলেও শহর এলাকায় এখন বিলুপ্তপ্রায়।

Related Articles

Back to top button