প্রকল্প পরামর্শক ব্যয় সাড়ে ৮৮ কোটি টাকা!
পল্লি সড়ক সংস্কার ও সেতু নির্মাণ

নিজস্ব প্রতিবেদক
পল্লি সড়কে নির্মাণ করা হবে সেতু। সেই সঙ্গে রাস্তা সংস্কার ও হাটবাজার উন্নয়নও হবে। এসব কাজের আগে ও পরের অবস্থা ধরে রাখার জন্য দৃশ্যপটের অডিও-ভিডিও নিয়ে তৈরি হবে চলচ্চিত্র। এজন্য চাওয়া হয়েছে ৬ কোটি টাকা।
সেই সঙ্গে বিভিন্ন খাতে পরামর্শ ব্যয় (পরামর্শক ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান) ধরা হয়েছে ৮৮ কোটি ৫১ লাখ টাকা। ‘পল্লি সড়কে গুরুত্বপূর্ণ সেতু নির্মাণ (দ্বিতীয় পর্যায়)’ শীর্ষক প্রকল্পে এসব ব্যয়ের প্রস্তাব করেছে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি)। এমন ব্যয় কতটা যৌক্তিক তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে-করোনা মহামারির সময় প্রশিক্ষণের নামে বিদেশ সফরসহ এ ধরনের ব্যয়ের লাগাম টানতে ব্যাপক উদ্যোগ নিয়েছিল সরকার। এখন মহামারি কিছুটা কমে আসায় অপ্রয়োজনীয় ব্যয়ের প্রবণতা ফের বাড়ছে। প্রস্তাবটি তারই প্রমাণ।
প্রকল্পটি বাস্তবায়নে মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ৪ হাজার ৫০ কোটি টাকা। প্রধান কাজ হচ্ছে-১৬ হাজার কিলোমিটার গ্রামীণ সড়ককে দুর্যোগ সহনীয় ২ লেন সড়কে উন্নীত করা । এছাড়া ৩৩ হাজার কিলোমিটার গ্রামীণ সড়ক উন্নয়ন এবং ১ লাখ ৬৫ হাজার মিটার সেতু নির্মাণ বা পুনর্বাসন করা হবে এর আওতায়। সেই সঙ্গে ৫০০টি গ্রোথ সেন্টার ও ১ হাজার ২০০টি বাজার উন্নয়ন করা হবে। জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় অনুমোদন পেলে সম্পূর্ণ সরকারি অর্থায়নে এটি বাস্তবায়ন হবে। ২০২৬ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে কাজ শেষ করবে স্থানীয় সরকার বিভাগের আওতায় এলজিইডি। খবর সংশ্লিষ্ট সূত্রের।
এ প্রসঙ্গে কথা হয় পরিকল্পনা কমিশনের ভৌত অবকাঠামো বিভাগের সদস্য (সচিব) মামুন-আল-রশীদের সঙ্গে। শনিবার তিনি বলেন, অডিও-ভিডিও তৈরির কিছু কাজ তাদের প্রয়োজন হয়ে থাকে। তবে এত বেশি টাকা লাগার কথা নয়। অনেক দিন আগে প্রকল্পটির পিইসি (প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটি) সভা হয়েছিল। তাই এই মুহূর্তে বিস্তারিত মনে পড়ছে না। এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, সড়ক ও জনপথের মতো এলজিইডির ডিজাইনের ক্ষেত্রে অতটা সক্ষমতা এখনো তৈরি হয়নি। তাদের দক্ষতা থাকলেও এতবড় প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে কিছু পরামর্শক দরকার আছে।
বিশ্বব্যাংক ঢাকা অফিসের সাবেক লিড ইকোনমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন বলেন, এ ধরনের প্রকল্পের সঙ্গে অডিও-ভিডিও বা চলচ্চিত্রের কি সম্পর্ক সেটিই বড় প্রশ্ন। কেননা যদি জনসচেতনতার বিষয় থাকত তাহলে না হয় বোঝা যেত এটার প্রয়োজন আছে। এ ধরনের ব্যয় মোট ব্যয়ের তুলনায় যত কমই হোক না কেন প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্যের সঙ্গে কতটা সঙ্গতিপূর্ণ সেটি দেখা জরুরি। আর এলজিইডি সারা জীবন ধরেই এসব কাজ করে। কর্মকর্তাদের বেতন-ভাতা ও বিভিন্ন সুবিধা দেওয়া হচ্ছে তাহলে তাদের দক্ষতা গড়ে উঠছে না কেন? প্রকল্প নিলেই পরামর্শক রাখা একটা প্রথা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।
সূত্র জানায়, স্থানীয় সরকার, পল্লি উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয় থেকে প্রস্তাব পাওয়ার পর ইতোমধ্যেই অনুমোদন প্রক্রিয়া শেষ করেছে পরিকল্পনা কমিশন। আগামী একনেক বৈঠকে প্রস্তাবটি উপস্থাপন প্রস্তুতি চূড়ান্ত হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে গ্রামীণ সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন ঘটবে। সেই সঙ্গে কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি, পরিবহণ ব্যয় ও সময় কমে যাওয়া এবং কৃষি ও অকৃষি পণ্য পরিবহণ ব্যবস্থা সহজ হবে। পাশাপাশি স্বল্প ও দীর্ঘ মেয়াদে কর্মসংস্থানেরও সুযোগ আসবে। এমন বিবেচনায় প্রকল্পটি প্রস্তাব করা হয়েছে।
প্রকল্পটির ব্যয় প্রস্তাব পর্যালোচনা করে দেখা যায়, অডিও ভিডিও/চলচ্চিত্র নির্মাণের জন্য ধরা হয়েছে ৬ কোটি টাকা। থোক থেকে এ বরাদ্দ চাওয়া হয়েছে। যা মোট প্রকল্প ব্যয়ের শূন্য দশমিক ১৪ শতাংশ। এছাড়া ব্যক্তি পরামর্শকের জন্য বরাদ্দ ধরা হয়েছে ৭৫ কোটি টাকা, যা মোট প্রকল্প ব্যয়ের ১ দশমিক ৮৫ শতাংশ। সেই সঙ্গে ১০০ মিটার ও এর ঊর্ধ্বে সেতুর জন্য সাব সয়েল ইনভেস্টিগেশন, টপো-গ্রাফিক্যাল সার্ভে, স্ট্রাকচারাল ডিজাইন, কস্ট এস্টিমেট ও টেন্ডার ডকুমেন্টেশন তৈরির জন্য পরামর্শক খাতে ১৩ কোটি টাকা ধরা হয়েছে। যা মোট প্রকল্প ব্যয়ের শূন্য দশমিক ৩২ শতাংশ।
পাশাপাশি টপোগ্রাফিক্যাল সার্ভের জন্য (১০০ মিটারের কম সেতু) পরামর্শক খাতে চাওয়া হয়েছে ৫১ লাখ টাকা। সেই সঙ্গে শুধু সম্মানী (কাদের জন্য সেটি উল্লেখ নেই) হিসাবে প্রস্তাব করা হয়েছে দেড় কোটি টাকা, যা মোট ব্যয়ের শূন্য দশমিক ০৩ শতাংশ।
কথা হয় স্থানীয় সরকার বিভাগের পরিকল্পনা, পরিবীক্ষণ, মূল্যায়ন ও পরিদর্শন অনুবিভাগের মহাপরিচালক ড. মোহাম্মদ এমদাদ উল্লাহ মিয়ার সঙ্গে। তিনি বলেন, এ মুহূর্তে বিস্তারিত বলতে পারছি না। তবে ধারণা হচ্ছে, অনেক সময় প্রকল্প শুরুর আগে কেমন ছিল এবং বাস্তবায়নের পর কেমন হয়েছে এমন বিষয়ে ডকমেন্টেশন তৈরি করা হয়। এতে পরে মূল্যায়ন করাটা সহজ হয়ে যায়। সম্ভবত এজন্য অডিও-ভিডিও ও চলচ্চিত্র নির্মাণের বিষয়টি এসেছে। তবে একসঙ্গে ৬ কোটি টাকা হয়তো অনেক বেশি মনে হতে পারে। কিন্তু এতবড় প্রকল্পে অনেক কার্যক্রমই বাস্তবায়ন করা হবে। সেক্ষেত্রে এই টাকা খুব বেশি বলা যায় না।
প্রকল্পটির প্রস্তাবে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয় থেকে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ দ্রুত অগ্রসরমান একটি দেশ। এদেশের বেশিরভাগ মানুষ গ্রামে বাস করে। এ অবস্থায় দেশের সার্বিক উন্নয়ন পল্লি এলাকার উন্নয়নের ওপর নির্ভরশীল। পল্লি উন্নয়নের একটি গুরুত্বপূর্ণ কৌশল হলো পল্লি অবকাঠামো উন্নয়ন করা। এটি গত তিন দশকে বাংলাদেশের অভিজ্ঞতা এবং দেশি-বিদেশি গবেষণায় প্রমাণিত। পল্লি সড়কে সেতু নির্মাণ বিভিন্নভাবে আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ও দারিদ্র্য বিমোচনে ব্যাপক ভূমিকা পালন করে। যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নের মাধ্যমে কৃষি-অকৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি, বাজারজাতকরণ সহজ করা ও নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে ভূমিকা পালন করে। এসব বিবেচনায় প্রকল্পটি প্রস্তাব করা হয়েছে।
সূত্র : যুগান্তর