ঢাকার যানজট কমাতে জরুরি স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি উদ্যোগ

রাজধানী ঢাকাকে অধিকাংশ বাঙালি ভালোবেসে স্বপ্নের ঢাকা, তিলোত্তমা রাজধানী, প্রাণের নগরী, জাদুর শহরসহ আরও অনেক আবেগ-অনুভূতির নাম দিয়েছে। নগরবাসীর কাছে রাজধানী ঢাকা যেমন ভালোবাসার ঠিকানা, উল্টো বসবাসের দিক থেকে নগরবাসীর জন্য শহরটি ভালোবাসার লাল গোলাপের ঠিক কাঁটার মতো অবস্থা হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ, প্রাণের শহরের রাস্তা যানজটে পরিপূর্ণ, যেখানে গাড়ির গতি মানুষের হাঁটার গতির কম, বাতাস আগের চেয়ে অনেক বেশি বিষাক্ত, অনেক এলাকার পানি দূষিত, সারা দিন দুর্বিষহ যানজট, অসহ্য শব্দদূষণ, ঘনবসতি—সব মিলিয়ে এটি বসবাসের অযোগ্য একটি শহরে পরিণত হয়েছে। ঢাকার যানজট বর্তমানে নগরবাসীকে শুধু নাকাল অবস্থায়ই ফেলেনি, বরং সারা দেশের মানুষের কাছে টক অব দ্য কান্ট্রিতে পরিণত হয়েছে। এ নিয়ে নানা কথা হয়েছে, হয়েছে গবেষণা; যানজট কমাতে হয়েছে মহাপরিকল্পনাও। আগে বলা হতো ফ্লাইওভার নির্মাণ করলেই যানজটমুক্ত হবে ঢাকা। কিন্তু না, তেমনটা হয়নি৷

করোনাভাইরাসের বিধিনিষেধ পেরিয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও অফিস-আদালত পুরোপুরি চালু হওয়ার পর যানজটে নাভিশ্বাস উঠছে নগরবাসীর। পবিত্র রোজা শুরুর পর বৈশাখের গরমের মধ্যে যানজট আরও অসহনীয় হয়ে পড়েছে। দীর্ঘ সময় যানজটে আটকে থেকে ইফতারও পথেই করতে হচ্ছে অনেককে। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) তথ্য অনুযায়ী, ঢাকায় গত তিন মাসে নিবন্ধিত হয়েছে প্রায় ৪৩ হাজার ৬২১টি যানবাহন। এর মধ্যে ব্যক্তিগত ও ছোট গাড়ি ৮ হাজার ৩৭৪টি। বাস ও মিনিবাস ৩৬২টি। আর সবচেয়ে বেশি নিবন্ধিত হয়েছে মোটরসাইকেল, ২৯ হাজার ১০৮টি। ২০২১ সালে ঢাকায় ১ লাখ ৫০ হাজার ৫৬১টি ও ২০২০ সালে ১ লাখ ১৮ হাজার ২৫৪টি যানবাহন নিবন্ধিত হয়েছিল। সব মিলিয়ে এ পর্যন্ত ঢাকায় ১৮ লাখ ১০ হাজার ২৭৫টি যানবাহন নিবন্ধিত।

অর্থাৎ, রাস্তার সংখ্যা ও পরিমাণ আগের মতো থাকলেও যানবাহন, বিশেষত ব্যক্তিগত যানবাহনের সংখ্যা ঢাকা শহরে অনেক গুণ বাড়ছে, যা যানজটকে বাড়িয়ে তোলায় মোক্ষম ভূমিকা পালন করছে।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অ্যাকসিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউট (এআরআই) পবিত্র রমজানের প্রথম দিন, ৩ এপ্রিল, ঢাকার মূল সড়কগুলোয় গাড়ির গতির ওপর এক গবেষণা চালিয়েছে। এতে দেখা গেছে, সেদিন ঢাকায় গাড়ির গড় গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ৪ দশমিক ৮ কিলোমিটার। ২০০৫ সালে একই ইনস্টিটিউটের করা গবেষণায় দেখা গিয়েছিল, সে সময় ঢাকা শহরে গাড়ির গড় গতি ছিল ঘণ্টায় ২১ কিলোমিটার। অর্থাৎ, ঢাকা শহরের হৃৎস্পন্দন ভয়াবহভাবে কমে গেছে। এই যে গাড়ির ঘণ্টাপ্রতি গতি, এটা একজন সুস্থ মানুষের হাঁটার গতির চেয়ে কম।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যমতে, একজন সুস্থ মানুষ যদি স্বাভাবিক গতিতে হাঁটে, তাহলে সে ঘণ্টায় পাঁচ কিলোমিটার বেগে হাঁটতে সক্ষম। ঢাকায় এখন একজন সুস্থ মানুষ হেঁটে গাড়ির আগে যেতে পারবে। অন্যদিকে বিআরটিএর তথ্য বলছে, ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সারা দেশে নিবন্ধিত মোটরযানের সংখ্যা ৫১ লাখ ১০ হাজার ৭৮৬। এর মধ্যে ব্যক্তিগত গাড়ি ৩ লাখ ৮৫ হাজার। বাস ৪৯ হাজার ৬৭৩টি।মোটরসাইকেলের সংখ্যা ৩৫ লাখ ৮৫ হাজার। অর্থাৎ, শুধু ঢাকা শহরেই নয়, বরং প্রতিনিয়ত সারা দেশে ব্যক্তিগত গাড়ির সংখ্যা অনেক গুণ বাড়ছে।

রাজউকের বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা (ড্যাপ) জরিপ অনুযায়ী, রাজউক এলাকায় সড়ক রয়েছে ১৩ হাজার ৮৬৫ কিলোমিটার। ৫ ফুট বা এর কম প্রস্থের সড়ক ১ হাজার ৭৮৭ কিলোমিটার, ৮ ফুট বা এর কম প্রস্থের রাস্তার দৈর্ঘ্য ৫ হাজার ২২ কিলোমিটার, ১০ ফুট বা এর কম প্রস্থের সড়ক ৮ হাজার ২৫৮ কিলোমিটার। ২০ ফুট বা এর চেয়ে বেশি প্রস্থের সড়ক রয়েছে ১ হাজার ৪৫৬ কিলোমিটার। সব মিলিয়ে রাজউক এলাকায় ১০ দশমিক ৫১ শতাংশ সড়ক রয়েছে, যেখানে আদর্শ মান ২৫ শতাংশ। অর্থাৎ, সড়কের সংখ্যা ও পরিমাণ পর্যাপ্ত না থাকলেও যানবাহন, বিশেষত ব্যক্তিগত যানবাহনের সংখ্যা ঢাকা শহরে অনেক গুণে বাড়ছে, যা যানজটকে বাড়িয়ে তোলায় মোক্ষম ভূমিকা পালন করছে।

রাজধানীর যানজট এতটাই খারাপ অবস্থায় যে নিউইয়র্ক টাইমস থেকে শুরু করে বিশ্বের বড় বড় শিক্ষাবিদও বিষয়টি নিয়ে লিখেছেন। তারপরও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই জট আরও ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে। গত দুই সপ্তাহে যানজটে প্রায় স্থবির হয়ে পড়েছে বাংলাদেশের রাজধানী। যানজট শুধু মৌলিক গতিশীলতা এবং মানসিক স্বাস্থ্যকেই প্রভাবিত করছে না, অনেক বড় অর্থনৈতিক প্রভাবও ফেলছে। বুয়েটের এআরআই অনুসারে, যানজটের কারণে ২০২০ সালে দেশের অর্থনীতিতে ৫৬ কোটি টাকা ক্ষতি হয়েছে। মহামারি করোনাভাইরাস আঘাত হানার আগে ঢাকায় যানজটের কারণে ৫০ লাখ কর্মঘণ্টা এবং ৩৭ হাজার কোটি টাকা নষ্ট হয়েছে। দুই বছর বিধিনিষেধ এবং স্কুল বন্ধ থাকার পর গত বছরের শেষ দিকে আবারও সবকিছু আগের অবস্থায় ফিরে এসেছে।

তিলোত্তমা নগরীর যানজট কমাতে স্বল্পমেয়াদি পরিবহন ব্যবস্থাপনাগত উদ্যোগের পাশাপাশি টেকসই পরিবহন-পরিকল্পনা ও নগর-পরিকল্পনার কার্যকর সমন্বয় প্রয়োজন। পাশাপাশি ঢাকার যানজট কমাতে এখনই কিছু টেকসই পরিবহন-পরিকল্পনায় (দীর্ঘ ও স্বল্পমেয়াদি) সমাধানের পথ খুঁজতে হবে। দীর্ঘমেয়াদি সমাধানের মধ্যে অন্যতম হলো দেশের আঞ্চলিক উন্নয়নের বিকেন্দ্রীকরণের মাধ্যমে ঢাকামুখী জনস্রোত ঠেকানো। কারণ, বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে নগর এলাকার জনঘনত্ব ৬০ থেকে ৮০ জন প্রতি একরে, যা অল্প কিছু আরবান ডিস্ট্রিক্ট এ সর্বোচ্চ ১২০ হতে পারে। কিন্তু ঢাকায় জনঘনত্ব একরপ্রতি ৩০০ থেকে ৪০০, কোনো কোনো এলাকায় ৬০০ থেকে ৭০০ প্রতি একরে। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা যায়, ঢাকা সড়কগুলো তাদের সক্ষমতার চেয়ে অনেক গুণ ট্রাফিক ধারণের কারণে অনিয়ন্ত্রিত যানজটের সম্মুখীন হচ্ছে। তাই ঢাকার যানজট নিয়ন্ত্রণে অতি দ্রুত দেশের আঞ্চলিক উন্নয়নের বিকেন্দ্রীকরণের মাধ্যমে ঢাকামুখী জনস্রোত ঠেকাতে হবে।

পাশাপাশি দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার মধ্যে ঢাকা সিটি করপোরেশন ঢাকা শহরের ভেতরে যে খালগুলো উদ্ধারে নেমেছে, সেগুলো সঠিকভাবে উদ্ধার করে নৌপথেও স্বল্প দূরত্বে ওয়াটার ট্যাক্সি চালু করতে পারে। সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ দীর্ঘমেয়াদি সমাধান হলো ব্যক্তিগত গাড়ি কেনায় নিরুৎসাহিতকরণ, গণপরিবহনের ভ্রমণের সুযোগ বৃদ্ধি ও গণপরিবহনে শৃঙ্খলা ফেরানো। পাশাপাশি ঢাকার চারপাশ ঘিরে যে নদী রয়েছে, তা ব্যবহার করা হলে রাস্তার ওপর চাপ কমবে।

এই জলপথে যদি লঞ্চ সার্ভিস কার্যকর করা যায়, তাহলে নগরবাসীর বড় একটি অংশ এটা ব্যবহার করে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যেতে পারবে; এমনটা থাইল্যান্ডে করা হয়েছে। কিন্তু আমাদের সুযোগ থাকার পরও তা করছি না। একটু লক্ষ করলে দেখা যায়, গণপরিবহন ঢাকা শহরের যানজট নিরসনে বড় সহায়ক হতে পারে। কারণ, রাস্তায় দাঁড়ালেই যখন বাস পাওয়া যাবে, তখন মানুষ রিকশা বা ব্যক্তিগত গাড়িতে না চড়ে বাসে চড়বে। গণপরিবহন উপযুক্ত ও ব্যবস্থাপনা ঠিকমতো হলে মানুষ শুধু ছুটির দিনে গাড়ি নিয়ে নগরের রাস্তায় বের হবে।

অন্যদিকে, বর্তমানে চলমান নাজুক অবস্থা থেকে নগরবাসীকে রক্ষা করতে অতি দ্রুত স্বল্পমেয়াদি কিছু পদক্ষেপ নেওয়া বেশ জরুরি। স্বল্পমেয়াদি সমাধানের মধ্যে সবচেয়ে বেশি কার্যকর ভূমিকা পালন করবে ট্রাফিক ও পার্কিং ডিমান্ড ম্যানেজমেন্ট স্ট্র্যাটেজি। যেমন স্কুল-কলেজগুলোর সময়সীমা ও ছুটির সূচি, মার্কেটগুলোর খোলা-বন্ধের সূচিতে বাস্তবসম্মত পরিবর্তন আনা যেতে পারে। পাশাপাশি পার্কিং ডিমান্ড ম্যানেজমেন্টের ক্ষেত্রে পার্কিং ব্যবস্থাপনাকে কার্যকর নীতিমালা ও ব্যবস্থাপনার মধ্যে নিয়ে আসতে হবে। অর্থাৎ, পার্কিং ব্যবস্থাকে শৃঙ্খলার মধ্যে আনার মাধ্যমে অবৈধ পার্কিং বন্ধ করা ও যত্রতত্র পার্কিং কিংবা রাস্তায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করার বিষয়ে যথাযথ আইন প্রয়োগ করতে হবে।

যানজট কমাতে বিশ্বের অনেক দেশ কার্যকর পদক্ষেপ নিয়ে সফল হয়েছে। তবে তারা যে প্রক্রিয়ায় সমাধান করেছে, একদম সেই একই প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশে সমাধান সম্ভব নয়। কারণ, ওই সব দেশের চিত্র আর বাংলাদেশের চিত্র পুরোপুরি এক নয়। পরিবহন আইন, মহাপরিকল্পনা ও ভূমি ব্যবহার প্রস্তাবনার ক্ষেত্রে আইনের যথাযথ প্রয়োগ ও আইনের শাসন নিশ্চিত করার পাশাপাশি পরিবহন ও নগর-পরিকল্পনাসংশ্লিষ্ট সব সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানের দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করা এবং দেশের উন্নয়নের বিকেন্দ্রীকরণের মাধ্যমে ঢাকার ওপর চাপ কমানোর মাধ্যমে ঢাকার ট্রাফিক সমস্যার কার্যকর ও টেকসই সমাধান করা সম্ভব। এ ক্ষেত্রে টেকসই পরিবহন-পরিকল্পনার মাধ্যমে স্বল্পমেয়াদি ট্রাফিক ব্যবস্থাপনাগত উদ্যোগের পাশাপাশি দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনাগত সমাধানের কার্যকর বাস্তবায়নে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন।

লেখক: মো. শাহ জালাল মিশুক, সহকারী অধ্যাপক, নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগ, চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়। shahjalalmisuk@gmail.com

Related Articles

Back to top button