ডলারের কৃত্রিম সংকট মোকাবেলায় করণীয়
বিশেষ সম্পাদকীয়

অধ্যাপক জাহাঙ্গীর আলম
শুধু বাংলাদেশ নয় বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক চরম মন্দা শুরু হয়েছে কোভিড-১৯ বা করোনার মহামারীতে। দীর্ঘ ২ বছর বাংলাদেশের পরিশ্রমি জনগণ সরকারের নানাহ প্রণোদনা সহযোগিতায় দেশ বিদেশে পরিশ্রম করে অর্থনীতিকে ঝুঁকিমুক্ত রেখে নজরকাড়া উন্নয়নসহ দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বিশ্বকে চরম বিপর্যয়ে ফেলেছে যার ভোগান্তীতে বাংলাদেশও পড়েছে। সরকার অত্যন্ত সতর্কতার সাথেই বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নিয়ে দেশের অর্থনীতিকে ঝুঁকিপূর্ণ রাখতে নানান পদক্ষেপ নিচ্ছেন। কিন্তু কতিপয় দুষ্ট চক্র ১৯৭১ সালের পাক দোসরদের মত দেশবিরোধী কর্মকান্ড শুরু করেছে ডলার নিয়ে। খোলা বাজারে ডলার সংকট কৃত্রিম-এটা করছে কুলাঙ্গাররা।
বাংলাদেশর একশ্রেণির অসাধু ঘুষখোর সরকারি কর্মকর্তা আর রাজনৈতিক লেবাসধারী কিছু দুর্নীতিবাজ কালো টাকার মালিক নিত্যপণ্য তথা চাল-ডাল আট লবনের মত খোলাবাজার থেকে ডলার কিনে মজুত করছে। অবৈধ টাকার মালিকদের একাংশ শেয়ার ব্যবসার মত ডলার ইউরো ক্রয়-বিক্রয় করে রাতারাতি কোটি টাকা কামানোর চেষ্টায় খোলা বাজার থেকে ডলার কিনে মার্কেটে সংকট তৈরি করছে। যদিও বাংলাদেশের ডলার মার্কেটে খোলা বাজারের ক্রয়-বিক্রয়ের প্রভাব ৫% এরও কম তবুও এটা নিয়ে জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছে। হঠাৎ করেই মাত্র অল্প কয়েকদিনের ব্যবধানে ৮৫-৮৬ টাকার ডলার খোলা বাজারে ১১২ টাকা পর্যন্ত হয়েছে।
ডলার সংকট সৃষ্টির অন্যতম কারণঃ
অবৈধ মজুত , বিদেশের পাচার ও হুন্ডিতে আমদানী কারকদের বাড়তি বিল পরিশোধে বেশি দামে বিক্রয়। খোলা বাজারের ডলার মার্কেটে কারা অস্থিরতা সৃষ্টির সাথে জড়িত তা সচেতন লোকজন যদি জানে নিশ্চয়ই আইন-শৃঙ্খলার বাহিনীও জানে! তাহলে নিরবতা কার স্বার্থে?
মতিঝিল সহ ঢাকার বিভিন্ন এলাকার সকল বড় ব্যাংক তথা সোনালী , জনতা অগ্রণীর বড় শাখায় ডজন ডজন অবৈধ ডলার ব্যবসায়ী আছে যারা আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীসহ সংশ্লিষ্ট ব্যাংক প্রশাসনকে ম্যানেজ করেই বছরের পর বছর অবৈধভাবে ডলারের ব্যবসা চালিয়ে আসছে। জুলাইতে গত ১৫ বছরের ইতিহাসে সর্বোচ্চ রেমিট্যান্স এসেছে যা ২.১০ বিলিয়ন ডলার প্রায় যদিও জুলাইতে জুন মাসের তুলনায় রপ্তানী কমেছে প্রায় ৯৩ কোটি ডলার। সুতরাং সতর্কতার বিকল্প নেই।
বাংলাদেশ ব্যাংকের লাইসেন্স নিয়ে প্রায় ৩ শতাধিক মানি এক্সচেঞ্জ হাউস বৈধতার নামে অবৈধভাবে ডলার ক্রয়-বিক্রয় করছে। চীন সহ একাদিক দেশে দেখেছি ডলার বা বৈদেশিক মুদ্রা ক্রয়-বিক্রয়ের একমাত্র মাধ্যম ব্যাংক। ব্যাঙের ছাতারমত মানি এক্সচেঞ্জ হাউস বা অবৈধ ডলার ব্যবসার হাট বিশ্বের অধিকাংশ দেশেই নেই।
সুপারিশ ঃ ডলার সংকট মোকাবেলায় যা করতে হবে।
১) অবৈধ ডলার হাট মানি এক্সচেঞ্জগুলো আপাতত কমপক্ষে ৩ মাসের জন্য বন্ধ রাখুন এবং ডলার ক্রয়-বিক্রয় একমাত্র ব্যাংকের মাধ্যমে করার প্রজ্ঞাপন জারি করুন। মানি এক্সচেঞ্জগুলোর সকল ডলার অপাতত বাংলাদেশ ব্যাংকে জমা রাখতে হবে।
২) অবৈধভাবে ডলার ব্যবসায়ী ও মজুতকারীদের ৩-৭ দিনের আল্টিমেটাম দিয়ে ১,০০০ ডলার এর বেশি সকল বৈদেশিক মুদ্রা ব্যাংকে জমা দিতে বলুন। অন্যথায় সকল মজুতকারীদের বিরুদ্ধে পুলিশী অভিযান ও বিশেষ ক্ষমতা আইনে মামলা শুরুর আইন জারি করুন।
৩) ঢাকার মতিঝিলসহ দেশের সকল জেলা-উপজেলা এমনকি ইউনিয়ন পর্যায়ে কারা অবৈধ ভাবে ডলার বা বৈদেশিক মুদ্রা ব্যাবসায় জড়িত তা পুলিশ ভালোভাবেই জানে। এদের বিরুদ্ধে সাঁড়াশি অভিযান পরিচালনা করুন।
৪) যারা বেশি লাভের আশায় বা বিদেশে পাচারের জন্য ডলার মজুত করছে গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে তাদের বাসা-বাড়ী বা অফিসে হানা দিয়ে তা আটক করুন এবং বিশেষ ক্ষমতা আইনে মামলা দিন।
৫) কাঁচা ফল, প্রসাধনী বা বিলাস দ্রব্য যে গুলোতে অতিরিক্ত শুল্ক সেটাতে ট্যারিফ ভ্যালু বা কমিশনার ভ্যালু চালু করুন যাতে আমদানী পর্যায়ে শুল্ক ফাঁকির প্রবণতায় হুন্ডি বন্ধ হয়ে আসে। এতে কাস্টম হাউসের দুর্নীতি ও কিছুটা কমে আসবে।
৬) বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের রপ্তানীর প্রায় ১২ বিলিয়ন ডলার পাওনা রয়েছে। এগুলো তাড়াতাড়ি দেশে আনার ব্যবস্থা করুন।
৭) ভারত-চীনের সাথেই আমাদের মোট আমদানীর প্রায় ৮০%। এ দুটি বন্ধু প্রতীম দেশের সাথে নিজস্ব মুদ্রায় আমদানী-রপ্তানি ব্যবসা চালু করতে বিশেষ উদ্যোগ নিন। এ উদ্যোগে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী হতে পারেন নিয়ামক শক্তি। তিনি যদি ভারত-চীনের সরকার প্রধানকে অনুরোধ করেন তাহলে আশা করি তারা রাজি হবেন। ভারত রাশিয়া, ইরান , চীন সহ বহ দেশ ইতিমধ্যেই নিজস্ব মুদ্রায় আন্তঃ বানিজ্য করছে। রাশিয়ার তেল অনেক দেশই কিনছে আপাতত নিজস্ব মুদ্রায়।
৮) সরকারি কর্মকর্তাদের অপ্রয়োজনীয় বিদেশ সফর নিরুৎসাহিত করে প্রজ্ঞাপন জারির পরে ৩০টি জিও নিয়ে ১৫০ জন কর্মকর্তা বিদেশ সফর করেছেন। প্রাক জাহাজীকরণ করতে টেকনিক্যাল লোকজনের সাথে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের উপ- যুগ্ম সচিব, মন্ত্রীর পিএস, এপিএস ও যা”েচ্ছ পরিবার নিয়ে। এসব চোরদের শক্ত হাতে দমন করুন।
৯) র্যামিট্যান্স যোদ্ধারাই প্রকৃত দেশপ্রেমিক। তাদের সমস্যাগুলো শুনতে এবং যথাযথ সমাধান দিতে আওয়ামী লীগের জনপ্রিয় বড় নেতাদের শ্রম ঘন দেশগুলোতে পাঠানো যায় এবং তারা বাঙালি এসোসিয়েশন বা দলের আয়োজনে সেমিনারে অংশ নিয়ে শ্রমিকদের সমস্যার সমাধান করবেন।তাদের সাথে থাকবেন দুতাবাস সহ পররাষ্ট্র ও প্রবাসী কল্যান মন্ত্রণালয়ের কর্তারা। দুতাবাসগুলো অধিকাংশ ক্ষেত্রেই জমিদারের মত আচরণ করছে তাদের সাথে। শ্রমিকরা তাদের কষ্টার্জিত আয় অল্প দুঃখে হুন্ডিতে পাঠায় না।
রেমিট্যান্স প্রণোদনার হার আগামী ৩-৬ মাসের জন্য ৫% করুন। এতে হাজার কোটি টাকা খরচ হলেও দেশের লাভ হবে। শ্রমিকরা টাকা পাচার করেনা। অথচ রপ্তানীর নামে যারা হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার করে ইউরোপ-আমেরিকা বা কানাডায় সেকেন্ডহোম করেছে তারাও রাষ্ট্রীয় প্রণোদনা পায়।
১০). দেশে ডলার আনার ক্ষেত্রে বিমান বন্দরে অযথা হয়রানী বন্দ করুন। কোন প্রকার প্রশ্ন ছাড়াই ডলার আনতে পারলে দেশের অনেক প্রবাসী বা বিভিন্ন ব্যবসায়ীরা ডলার নিয়ে আসবেন। মনে রাখতে হবে
” সবার উপরে দেশ ”