টসটসে পেয়ারা সকালে তুলে দুপুরেই ঢাকায়

স্বরূপকাঠির চাষিরা খুশি, পাইকাররা ফুরফুরে

পিরোজপুর প্রতিনিধি
পিরোজপুরের স্বরূপকাঠি উপজেলার আটঘর-কুড়িয়ানায় উৎপাদিত দেশি পেয়ারার এখন ভরা মৌসুম। প্রতি শুক্র ও সোমবার হাটের দিন তো বটেই, অন্য দিনগুলোয়ও পেয়ারার বিকিকিনিতে সরগরম কুড়িয়ানা খালের ভাসমান হাটবাজার। দূর-দূরান্ত থেকে পাইকাররা আসছেন।

স্বল্পমূল্যে পেয়ারা কিনে ট্রাক-পিকআপ বা ট্রলারে ঢাকা, বরিশাল, চাঁদপুরসহ বিভিন্ন গন্তব্যে নিয়ে যাচ্ছেন দিনে দিনে। বিশেষ করে ঢাকার পেয়ারার পাইকাররা এ মৌসুমে রয়েছেন ফুরফুরে মেজাজে। স্বপ্নের পদ্মা সেতু খুলে দেওয়ায় ফেরির ৮-৯ ঘণ্টার বিড়ম্বনার পরিবর্তে মাত্র সাড়ে তিন থেকে চার ঘণ্টার মধ্যেই স্বরূপ জাতের তাজা এ পেয়ারা নিয়ে ঢাকায় পৌঁছাতে পারছেন। এজন্য তারা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সুস্থতা ও দীর্ঘজীবন কামনা করছেন। পিরোজপুর জেলার পুরোনো ব্যবসাবান্ধব উপজেলার নাম নেছারাবাদ।

এ উপজেলার আটঘর-কুড়িয়ানা ইউনিয়ন প্রসিদ্ধ পেয়ারার কারণে। তবে এখন আশপাশের কয়েকটি ইউনিয়নেও ছড়িয়ে পড়েছে পেয়ারার আবাদ। বাগান থেকে মালিকরা নিজেরাই পেয়ারা তুলে ছোট-বড় খাল হয়ে ছোট ছোট ডিঙি নৌকায় করে ভাসমান হাটে পেয়ারা বেচতে আসেন। সকাল থেকে বেলা ৩টা পর্যন্ত চলে বিকিকিনি।

সোমবার ভাসমান হাট ঘুরে দেখা যায়, ছোট ছোট খাল থেকে ছোট্ট ডিঙি করে বাগান মালিকরা তাদের পেয়ারা নিয়ে কুড়িয়ানার ভাসমান খালে (হাটে) আসছেন। অপেক্ষারত বিভিন্ন স্থানের আড়তদার, পাইকার ও ক্রেতারা পেয়ারাভর্তি নৌকা দেখলেই হাঁক দিচ্ছেন। তারপর শুরু দরকষাকষি। প্রতি মন পেয়ারা বিক্রি হচ্ছে ৪০০ থেকে ৫০০ টাকায়।

ঢাকা থেকে পেয়ারা কিনতে আসা আব্দুল সালাম জানান, পদ্মা সেতু হওয়ায় এখন আমাদের প্রায় অর্ধেক সময় কমে গেছে, ফেরির বিড়ম্বনা না থাকায় দিনে দিনেই সতেজ পেয়ারা নিয়ে ঢাকায় যেতে পারছি। ট্রাক ড্রাইভার মোস্তফা বলেন, আমরা পদ্মা সেতু পেয়ে অনেক খুশি। ৩-৪ ঘণ্টায় পেয়ারা নিয়ে ঢাকা যেতে পারছি, মনে অনেক শান্তি। আগে ফেরির কারণে কাঁচামাল পথেই নষ্ট হয়ে যেত, এখন আর হয় না।

আড়তদার মো. তাসুউদ্দিন বলেন, এখানকার পেয়ারা খুব সুস্বাদু। এ বছর পেয়ারার ফলন ভালো হলেও বর্ষার কারণে ফল বাজারে এসেছে কিছুটা দেরিতে। দাম গত বছরের মতোই আছে। জিন্দাকাঠি গ্রামের পেয়ারার বাগান মালিক গৌরাঙ্গ মন্ডল বলেন, আমরা নিজেরাসহ বদলা নিয়ে পেয়ারা পারতে কমপক্ষে ১২-১৪ হাজার টাকা বেতন দিতে হয়। ৪০০ টাকা মন দরে পেয়ারা বিক্রির পর যা থাকে তাতে কোনোভাবে সংসার চলে। দাম আরেকটু বেশি পেলে ভালো হতো। কৃষি বিভাগের মতে, পিরোজপুর জেলার স্বরূপকাঠিতেই রয়েছে ৬৫৭ হেক্টর জমিতে ২ হাজার ২৫টি পেয়ারা বাগান। এখানে প্রায় ১৬ লাখ মন পেয়ারা প্রতিবছর উৎপাদিত হয়, যার মূল্য প্রায় ৬০ কোটি টাকা। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রায় ৮ হাজার মানুষ পেয়ারার সঙ্গে জড়িত।

সূত্রমতে, প্রতিবছর পেয়ারার মৌসুম শুরু হলে দূর-দূরান্ত থেকে পেয়ারার স্বাদ নিতে ও মনোরম বাগান দেখছে ছোট ছোট ট্রলার, মোটরবাইক ও বিভিন্ন বাহনে পর্যটকরা এখানে আসেন। ভ্রমণপিপাসুদের বিষয়টি মাথায় রেখে এখানে গড়ে উঠেছে ভাসমান পেয়ারা পার্ক ও পিকনিক কর্নার, রয়েছে কাঠের সাঁকোতে পেয়ারা বাগানে ঘুরে বেড়ানোর সুযোগ। আইনশৃঙ্খলা রক্ষার জন্য পুলিশ ফাঁড়ি বসানো হয়েছে। এবার এ ভিড় যেন একটু বেশি। অল্প সময়ে স্বরূপকাঠি আসতে পেরে শুধু ঢাকা নয়, অন্য এলাকার মানুষও ছুটে আসছেন।

বরিশাল থেকে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে পেয়ারা বাগানে ঘুরতে আসা লায়লা ফেরদৌসী বলেন, এখানের পরিবেশটা খুবই সুন্দর। এলে যে কারোরই মন খুশিতে ভরে উঠবে। বরিশাল থেকে ঘুরতে আসা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের ছাত্র মো. মাইনুল হাসান বলেন, আমরা ছেলেমেয়ে মিলে (শিক্ষার্থী) ১১ জন পেয়ারা বাগান দেখতে এসেছি। খুবই চমৎকার পরিবেশ।

কুড়িয়ানার আদমকাঠি গ্রামের ‘ফ্লোটিং পেয়ারা পার্ক অ্যান্ড পিকনিক স্পটের’ মালিক প্রণয় মজুমদার জানান, আমরা এখন পর্যন্ত এখানে আয়ের মুখ দেখতে পারিনি, বছরে এখানে মালিককে ৫০ হাজার টাকা দিতে হয়, তবে এবার আশার আলো দেখতে পাচ্ছি।

আটঘর-কুড়িয়ানা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মিঠুন হালদার জানান, এই পেয়ারার বাজারে কোনো শেড নেই, যেখানে বসে পেয়ারা বেচাকেনা করা যায়। পেয়ারা বর্ষা মৌসুমের একটি ফল, এ কারণে সরকারিভাবে দ্রুতই একটি শেড নির্মাণ প্রয়োজন। এখানে একটি হিমাগার স্থাপনের জন্য কয়েক দফা প্রস্তাব সরকারের কাছে দেওয়া হয়েছে; কিন্তু এখন পর্যন্ত তা বাস্তবায়ন হয়নি। তা হলে কৃষকরা পেয়ারার আরও মূল্য পেতেন।

পেয়ারা চাষিরা জানান, আটঘর-কুড়িয়ানা, জিন্দাকাঠি, আদমকাঠি, ভীমরুলী, ধলহারসহ বিভিন্ন পেয়ারা বাগানের খ্যাতি শত বছরের। এখানকার প্রত্যন্ত অঞ্চলের চাষিদের অর্থ উপার্জনের একমাত্র পথ পেয়ারা চাষ। সরকার আর্থিক সহায়তা দিলে, সহজ শর্তে ব্যাংক ঋণ এবং কৃষি কর্মকর্তাদের সময়োপযোগী পরামর্শ পেলে কৃষকরা আরও এগিয়ে যেতে পারবেন। নানা কারণে যেসব ক্ষতির মুখে রয়েছেন তারা, তা কাটিয়ে উঠতে পারবেন।

Related Articles

Back to top button