চট্টগ্রামে ব্যাংকঋণের ৭৯ শতাংশই দুই থানায়

প্রাচ্যবাণী রিপোর্ট
গত বছরের ডিসেম্বর শেষে চট্টগ্রাম জেলায় বিতরণকৃত ব্যাংকঋণের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ৯১ হাজার ৫৬৭ কোটি টাকা। এটি সারা দেশে বিতরণকৃত মোট ঋণের ১৫ দশমিক ৮২ শতাংশ। জেলার ৩২টি থানার মধ্যে সবচেয়ে বেশি ৯০ হাজার ৬৩ কোটি টাকার ঋণ বিতরণ করা হয়েছে কোতোয়ালি থানায়। আর ডবলমুরিং থানায় বিতরণ করা হয়েছে ৬১ হাজার ৮৯৮ কোটি টাকার ঋণ। চট্টগ্রাম জেলায় বিতরণকৃত ঋণের ৭৯ শতাংশই দেয়া হয়েছে এ দুই থানায়।

এছাড়া পাঁচলাইশ থানায় ১০ হাজার ৪৫২ কোটি টাকা, পাহাড়তলী থানায় ২ হাজার ৮৭৫ কোটি, বন্দর থানায় ২ হাজার ৮৫৯ কোটি, বাকলিয়া থানায় ২ হাজার ৬৮৬ কোটি, চান্দগাঁও থানায় ২ হাজার ৩৫৯ কোটি, হাটহাজারী থানায় ২ হাজার ২১৫ কোটি, সীতাকুণ্ড থানায় ১ হাজার ৯৯৫ কোটি ও পটিয়া থানায় ১ হাজার ৮৮৫ কোটি টাকার ঋণ বিতরণ করা হয়েছে।

সারা দেশের খেলাপি ঋণের উল্লেখযোগ্য একটি অংশ চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীদের। এর মধ্যে চট্টগ্রামের একসময়ের শীর্ষস্থানীয় একাধিক শিল্প গ্রুপের ব্যাংক থেকে নেয়া বিপুল পরিমাণ ঋণ খেলাপি হয়েছে। সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলো নিয়মিত কাজের অংশ হিসেবে মামলা করলেও একাধিক পক্ষের সঙ্গে যোগসাজশের ভিত্তিতে খেলাপি গ্রাহকরা দিনের পর দিন ঋণ পরিশোধ না করে ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। আবার কেউ কেউ এরই মধ্যে হয়েছেন দেশান্তরী।

তবে চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীরা দাবি করছেন, জেলার প্রধানতম বাণিজ্যকেন্দ্র খাতুনগঞ্জ। দেশে ভোগ্যপণ্যের অন্যতম প্রধান বাজারও এটি। একসময় ভোগ্যপণ্য আমদানি ও দেশীয় বাণিজ্যের ৮০ শতাংশই হতো এখান থেকে। বর্তমানে এ প্রভাব কমে এলেও ভোগ্যপণ্যে খাতুনগঞ্জের অবদান প্রায় ৪০ শতাংশ। এজন্য চট্টগ্রামকেন্দ্রিক ব্যাংকঋণের অনেকটাই খাতুনগঞ্জকে ঘিরে। কোতোয়ালি থানার আওতাধীন এ অঞ্চল থেকেই ব্যবসায়ীদের একটি বড় অংশ পরবর্তী সময়ে শিল্পে প্রবেশ করেছে এবং চট্টগ্রামসহ সারা দেশের শিল্প খাতে স্বনামধন্য ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে রূপান্তরিত হয়েছে।

চট্টগ্রামের বড় করপোরেট প্রতিষ্ঠানের অনেকগুলোই এখনো নিজেদের প্রধান কার্যালয় খাতুনগঞ্জে রেখে ব্যবসায়িক কার্যক্রম চালাচ্ছে। দেশের ভোগ্যপণ্য, শিল্প ও ব্যাংক খাতের বড় প্রতিষ্ঠান এস আলম গ্রুপের প্রধান কার্যালয় এখনো খাতুনগঞ্জেই। এছাড়া এনজিএস গ্রুপ, জিপিএইচ গ্রুপ, টিকে গ্রুপ, ইমাম গ্রুপ, বিএসএম গ্রুপসহ বেশ কয়েকটি শিল্প ও কমোডিটি জায়ান্টের প্রায় শতভাগ কার্যক্রমই পরিচালিত হয় খাতুনগঞ্জে। এমইবি, মোস্তফা, নূরজাহান, এসএ গ্রুপ, পিএইচপিসহ অন্য শিল্প গ্রুপগুলো খাতুনগঞ্জ থেকে করপোরেট অফিস সরিয়ে নিলেও কোনো না কোনোভাবে খাতুনগঞ্জে ব্যবসায়িক কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত। কেউ কেউ খাতুনগঞ্জ থেকে প্রধান কার্যালয় সরিয়ে ডবলমুরিং থানাধীন আগ্রাবাদ এলাকায় থিতু হয়েছে। আগ্রাবাদ বাণিজ্যিক এলাকাকে বলা হয় চট্টগ্রামের মতিঝিল। ডবলমুরিং থানাধীন এ এলাকায় দেশের ইস্পাত ও শিপব্রেকিং খাতের প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রধান কার্যালয়। মেশিনারিজ ও গার্মেন্ট খাতের বাণিজ্য সবচেয়ে বেশি হয় এ এলাকায়। যার কারণে কোতোয়ালি থানার পর চট্টগ্রামের সবচেয়ে বেশি ঋণ এ এলাকায় দেয়া হয় বলে মনে করছেন ব্যাংকার ও ব্যবসায়ীরা।

দ্য ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার্স অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এফবিসিসিআই) সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন বলেন, আমাদের দেশে সবকিছুই কেন্দ্রীভূত। দেশের অর্থনীতির বড় একটি অংশ রাজধানী ঢাকাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে। একইভাবে চট্টগ্রামেও নির্দিষ্ট কয়েকটি এলাকায় শিল্প, কল-কারখানা ও ব্যবসা-বাণিজ্য কেন্দ্রীভূত। শিল্প-কারখানা কিছুটা বিকেন্দ্রীকরণ হলেও কার্যালয় ও পাইকারি বাজার এখনো সেসব এলাকায় রয়ে গেছে। মিরসরাইতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্পনগর চালু হয়ে গেলে সেখানে ব্যাংকের লেনদেন অনেক বেড়ে যাবে। একইভাবে অন্যান্য এলাকায়ও এ ধরনের বিকেন্দ্রীকরণ হওয়া উচিত।

কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের পরিসংখ্যান বলছে, ২০২০-২১ অর্থবছর শেষে চট্টগ্রামে ৮২ হাজার ১০৩টি অনিবন্ধিত কারখানা, দোকান ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে। এর মধ্যে অনিবন্ধিত পোশাক বা আরএমজি কারখানার সংখ্যা ৩৪৩ ও নন-আরএমজি কারখানার সংখ্যা ৪ হাজার ২০০। একইভাবে অনিবন্ধিত দোকানের সংখ্যা ৭২ হাজার ও প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ৫ হাজার ৫৬০। অন্যদিকে চট্টগামে নিবন্ধিত মোট কারখানা, দোকান ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে ৯ হাজার ৫৬৫টি। এর মধ্যে আরএমজি কারখানা ১ হাজার ১৬৭, নন-আরএমজি ৩ হাজার ৬২৩, দোকান ২ হাজার ৬৬২ ও প্রতিষ্ঠান ২ হাজার ১১৩টি।

ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেডের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট শাহাদাত হোসাইন এ প্রসঙ্গে বলেন, খাতুনগঞ্জ দেশের মোট বাণিজ্যের বড় একটি অংশ দখল করে আছে। যার কারণে এখানকার ব্যবসায়ীরা অবাধে ও সহজে ঋণ সুবিধা পান। দীর্ঘদিনের বিশ্বাস, ভোগ্যপণ্যসহ যেকোনো আমদানি বাণিজ্যে ব্যাংকের সঙ্গে ব্যবসায়ীদের সুসম্পর্ক ঋণ কার্যক্রমে খাতুনগঞ্জসহ আশপাশের অঞ্চল এগিয়ে। তবে সময়ের পরিক্রমায় এ ধারাবাহিকতা কমে আসছে। এখন অন্যান্য অঞ্চলেও ঋণপ্রবাহ বেড়েছে। ব্যাংকিং ধারণা ও সংস্কৃতির পরিবর্তনের ধারায় অঞ্চলভিত্তিক ঋণ প্রদানের একক আধিপত্য ধীরে ধীরে কমে আসবে।

ব্যবসায়ীরা বলছেন, কোতোয়ালি থানাকে কেন্দ্র করে রয়েছে চট্টগ্রামের প্রধান প্রধান বেশ কয়েকটি খাতের বাণিজ্য কেন্দ্র। কোতোয়ালি এলাকার আশপাশে রয়েছে খাতুনগঞ্জ, চাক্তাই, আছদগঞ্জ, সদরঘাট, নিউমার্কেট, রিয়াজউদ্দিন বাজার, টেরিবাজার, আন্দরকিল্লা ও জুবিলি রোড। চট্টগ্রামের অন্যান্য প্রায় সব ধরনের ব্যবসার প্রধান কেন্দ্র ধরা হয় এ কয়েকটি অঞ্চলকে। যেমন প্রিন্টিং, হার্ডওয়্যার, স্যানিটারি, আমদানি পোশাক, কসমেটিকস, ইলেকট্রনিকসহ বিভিন্ন পণ্যের বড় পাইকারি ও আমদানি ব্যবসা কোতোয়ালি থানার এলাকাগুলোয়।

দ্য চিটাগং চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের সভাপতি মাহবুবুল আলম বলেন, খাতুনগঞ্জ চট্টগ্রাম তথা সারা দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যের আঁতুড়ঘর। এখানকার ব্যবসায়ীরাই গোটা চট্টগ্রাম এমনকি দেশের অন্যতম শীর্ষ শিল্প গ্রুপের কাতারে উঠে এসেছে। খাতুনগঞ্জের জৌলুশ কালের পরিক্রমায় কমলেও শেষ হয়ে যায়নি। যার প্রমাণ ব্যাংকগুলোর ঋণপ্রবাহের চিত্র থেকেই বোঝা যায়। তাছাড়া ব্যবসার স্থান কিংবা অফিস পরিবর্তন হলেও মূল কাঁচামাল বন্দর কিংবা খাতুনগঞ্জের মাধ্যমে আসে বলেই কোতোয়ালি বা ডবলমুরিং এলাকা চট্টগ্রামের ব্যাংকগুলোর জন্য সবচেয়ে বেশি গ্রাহকসমৃদ্ধ।

তবে চট্টগ্রাম অর্থঋণ আদালতের তথ্য বলছে, ২০১৩ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত আট বছরে সব খাত মিলিয়ে জেলাটিতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৩৫ হাজার কোটি টাকার বেশি। এর মধ্যে ভোগ্যপণ্যে নেয়া ১৪ হাজার কোটি টাকা ঋণ খেলাপি হয়েছে। এসব ঋণগ্রহীতার অনেকেই কিস্তি পরিশোধ না করলেও ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন। কেউবা দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন। খেলাপি ঋণগ্রহীতা অনেক ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে এরই মধ্যে জারি করা হয়েছে গ্রেফতারি পরোয়ানা।

ব্যাংক ও আদালত সূত্রে জানা গিয়েছে, চট্টগ্রামের যেসব শীর্ষ ঋণখেলাপি প্রতিষ্ঠানসংশ্লিষ্ট আসামিদের বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হয়েছে, সেগুলোর মধ্যে রয়েছে নূরজাহান গ্রুপ, রুবাইয়া গ্রুপ, এমইবি গ্রুপ, বাগদাদ গ্রুপ, মেসার্স হারুন ট্রেডিং, মেসার্স ইয়াসির এন্টারপ্রাইজ, সাইফ স্টিল রি-রোলিং মিলস, মেসার্স গোল্ডেন শিপ ব্রেকিং, মেসার্স বনলতা গার্মেন্টস ইত্যাদি। এসব প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার ও পরিচালকদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন ব্যাংকের একাধিক মামলা রয়েছে। আদালতের জারি করা গ্রেফতারি পরোয়ানাও রয়েছে।

সূত্র : বণিক বার্তা

Related Articles

Back to top button