এলটিএম টেন্ডারে দেউলিয়া হচ্ছে ঠিকাদার – লাভবান হচ্ছে প্রকৌশলী আর ব্যাংক!
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সমীপে

অধ্যাপক জাহাঙ্গীর আলম
দেশের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে বড় ঠিকাদারদের একচ্ছত্র আধিপত্য কমাতে এবং যথাসময়ে উন্নয়নকাজ শেষ করার মাধ্যমে জনগণকে সুফল দিতে প্রধানমন্ত্রীর যুগান্তকারী সিদ্ধান্তে সীমিত দরপত্র প্রক্রিয়া (এলটিএম টেন্ডার সিস্টেম)। মূলত নতুন ঠিকাদার তৈরি করার লক্ষ্যেই প্রধানমন্ত্রী এ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। প্রকৌশলীদের কূটচালে পড়ে এখন এটা বুমেরাং হয়ে উঠছে। এলটিএম টেন্ডার প্রক্রিয়া যেন এখন নতুন ক্যাসিনো গেম। শেষ বা দেউলিয়া হয়ে যাচ্ছে নতুন ঠিকাদার আর লাভবান হচ্ছে দুর্নীতিবাজ প্রকৌশলী এবং সরকারি-বেসরকারি ব্যাংক সমূহ।
সরকারের সিদ্ধান্ত মোতাবেক পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় পিপিআর ২০০৮ এর সংশোধনী প্রকাশ করে ২০১৯ সালে যে , ৩ কোটি টাকা পর্যন্ত এলটিএম টেন্ডারে দরপত্র আহ্বান করতে হবে। প্রকৃতপক্ষে এলজিইডি, গণপূর্ত বিভাগ এবং বিআইডাব্লিউটিএ, ডিএনসিসি, ওয়াসাসহ কয়েকটি বাদে বহু সংস্থা কোন কাজই সীমিত দরপত্র প্রক্রিয়ায় টেন্ডার করেনা।
ঢাকা দক্ষিন সিটি কর্পোরেশন, জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল বিভাগ সহ বহু সংস্থা সরকারের নির্দেশনাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে কোন এলটিএম টেন্ডারই করে না। তারা তাদের পছন্দের ঠিকাদারকে কাজ দিতেই ওটিএম টেন্ডারে সকল দরপত্র আহ্বান করে। এতে করে সংশ্লিষ্ট নির্বাহী প্রকৌশলীরা ১০% -১৫% ঘুষ নেয়ার সুযোগ পায়।
যে সকল দপ্তর এলটিএম টেন্ডার করে তাদের প্রায় সবারই সিডিউল মূল্য কমপক্ষে ১,০০০ টাকা। পিডাব্লিউডিসহ একাধিক দপ্তরে দেখা যায় ৪ লাখ টাকার কাজেই ৩০০ থেকে ৪০০ ঠিকাদার অংশ নিচ্ছে অর্থ্যাৎ কাজের দাম উঠে আসছে সিডিউল বিক্রি করেই।
সিডিউল ক্রয়, পে-অর্ডার করার খরচসহ একটা ছোট টেন্ডারে অংশ নিতেই ঠিকাদারের খরচ পড়ে গড়ে ৩,০০০-৪,০০০ টাকা। একজন ঠিকাদার বছরে গড়ে ১০০ টেন্ডার দিতেই খরচ পড়ে ৩-৪ লাখ টাকা। কাজ না পেলে ঐ ঠিকাদার দেউলিয়া।
সিডিউল বিক্রিসহ সকল টাকা থাকে ব্যাংকে দীর্ঘ সময়। পিডিবি-ডিএনসিসি সহ বহু সংস্থা মাসের পর মাস সকল ঠিকাদারের পে-অর্ডার আটক করে রাখে বিনা কারণে আর যারা ঘুষ দেয় তাদেরকে ফেরৎ দেয়।
টেন্ডার লটারী করার এবং যারা কাজ পায়না তাদের পে-অর্ডার ফেরৎ দেয়ার কোন সময় নির্দিষ্ট নেই। এটা সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলীর মর্জি মাফিক। সিপিটিইউতে অভিযোগ করার পরও কোন প্রতিকার নেই।
ওটিএম টেন্ডারের ক্ষেত্রে প্রকৌশলীর পছন্দের ঠিকাদারকে কাজ দেয়ার জন্য গোপন দর শুধু একজনকেই বলেন এবং নির্দিষ্ট ঠিকাদারই ১০০% সঠিকভাবে দর দাখিল করতে পারেন এবং সর্ব নিন্ম দরদাতা হন। অন্যদের কারো বেশি হয়, কারো কম হয়। দরপত্রের এ প্রক্রিয়া শতভাগ দুর্নীতিগ্রস্ত।
আগে সকল টেন্ডারে প্রাক্কলিত মূল্য উল্লেখ ছিলো। ঠিকাদার শুধুমাত্র % দিয়ে কম বেশি করতে পারতো। তখন সকল কাজই ৫% এর কম দরদাতা সরাসরি বাতিল হয়ে যেত। এখনকার দুর্নীতিবাজ প্রকৌশলীরা ঠিকাদারদের ২০%-২৫% কমেও দর দাখিলে উৎসাহিত করেন। তখন আর কোন কাজই করতে হয় না শুধুই ভাগাভাগি ।

ঠিকাদারীর কাজে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে যা করা দরকার তথা সুপারিশসমূহ ঃ
(১) সরকারের সকল দপ্তর-অধিদপ্তরের সকল প্রকল্পের কাজই ৫ কোটি টাকা পর্যন্ত সকল দরপত্র এলটিএম টেন্ডারে করার নির্দেশনা জারি করুন। এর ব্যাত্যয় হলে ঐ সংস্থার দায়িত্বশীলদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার পাশাপাশি সকল প্রকার বিল প্রদান স্থগিত করুন।
(২) এলটিএম টেন্ডার না করলে বা আইনের ফাঁক-ফোঁকর দিয়ে ৫ কোটি টাকার কম কাজের ওটিএম টেন্ডার করলে ঐ দরপত্র আহ্বানকারী সংস্থা প্রধান, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী সচিবের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করুন এবং টেন্ডার বাতিল করুন।
(৩) লটারীর পর কাজ না পাওয়া ঠিকাদারদের পে-অর্ডার ফেরৎ না দিয়ে মাসের পর মাস আটক রেখে ঠিকাদার জিম্মি করে প্রকৌশলীরা। এলটিএম টেন্ডারের দাখিল হওয়ার সর্বোচ্চ ৫ কার্য দিবসের মধ্যে লটারী করে ১ম, ২য় ও ৩য় ঠিকাদার নির্বাচিত করে অন্য দরদাতাদের পে-অর্ডার ৩ দিনের মধ্যে ফেরৎ দেয়ার বিধান করুন। লটারীতে ১ম দর দাতার দাখিলকৃত কাগজ সঠিক না হলে ২য় জন, সেটা না হলে ৩য় জন কাজ পাবে। ৩য় জনেরও কাগজ ঠিক না পেলে পুণঃরায় টেন্ডার করার বিধান করুন। ১ম দর দাতার কাগজ যাচাই করার নামে ঠুনকো অজুহাতে মাসের পর মাস পে-অর্ডার আটক রেখে ছোট ঠিকাদারদের ব্যাংক সুদে হত্যার উদ্যোগ বন্ধ করুন।
(৪) কমপক্ষে ৫০ কেটি টাকা পর্যন্ত ওটিএম টেন্ডারে প্রাক্কলন উন্মুক্ত করুন এবং ৫% এর বেশি নিম্ন দরদাতার দরপত্র বাতিল করার বিধান করুন। এর ফলে প্রকৌশলীর ঘুষের বিনিময়ে পছন্দের ঠিকাদারকে কাজ দিতে পারবেনা। প্রাক্কলন উন্মুক্ত ও ৫% সর্বনিম্ন দর হলে এলটিএম এর মত বহু ঠিকাদার অংশ নিতে পারবে এবং কাজের মানও ভালো হবে এবং যথাসময়ে কাজও শেষ হবে। ওটিএম টেন্ডারের সমগ্র প্রক্রিয়াটাই এখন প্রকৌশলীদের নিয়ন্ত্রণে এবং তারা যাকে মনে করেন সে ঠিকাদারই সঠিক দরদাতা হয়। দরপত্রের ওটিএম প্রক্রিয়া এখন শতভাগ দুর্নীতিগ্রস্ত।
(৫) এলটিএম টেন্ডারে সিডিউলের দাম কমানো জরুরি। ১০০-৫০০ টাকা তথা নামে মাত্র মূল্যে সিডিউল ক্রয় এবং পে-অর্ডার না নিয়ে সংশ্লিষ্ট বিভাগে ৫০,০০০-১০০,০০০ টাকার নিরাপত্তা জামানত নিলে ঠিকাদারদের ব্যাংক ঋণের চাপ কমে আসবে। এতে সারা দেশে প্রতি বছর হাজার হাজার নতুন ঠিকাদার গড়ে উঠবে যাদের ৯০% ই ক্ষমতাসীন দলের সহযোগী সংগঠনের বেকার কর্মী। অন্যথায় টেন্ডার জটিলতায় সারা দেশের নতুন ঠিকাদাররা দেউলিয়া হয়ে যাচ্ছে-যাবে যাদের ৯০% ক্ষমতাসীন দলের সহযোগী সংগঠনের বেকার কর্মী।
আমলাতন্ত্রের কটু চাল থেকে ওটিএম, এলটিএম টেন্ডার প্রক্রিয়া সহজ করতে না পারলে ঠিকাদারী ব্যবসায় নিয়ন্ত্রণ বিএনপিপন্থী তথা বড়দের দখলেই থাকবে।
৬). এলটিএম টেন্ডারে ঠিকাদারের বিগত ৫ বছরের একই কাজের অভিজ্ঞতা সংক্রান্ত জটিল শর্ত বাতিল করুন। এটার পরিবর্তে সে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের বিগত দিনের যে কোন সময়ের অভিজ্ঞতাকে বিবেচনায় নিয়ে উন্মুক্ত টেন্ডারে অংশ গ্রহনের সুযোগ সহজ করুন। একজন ঠিকাদার বিগত ৫ বছরে ঠিকাদারী ব্যবসার পরিবর্তে অন্য ব্যবসায় থাকতে পারে বা অসুস্থ থাকতে পারে বা বিদেশে থাকতে পারে বা শত শত টেন্ডার দেয়ারপরও কাজ না পেতে পারেন। সে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের বিগত দিনের যে কোন সময়ের অভিজ্ঞতাকেই বিবেচনায় নিলে তিনি এবং দেশ উভয়েই লাভবান হবেন।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সদয় ব্যবস্থা নিন।