অর্ধকোটি টাকার সিলিং নির্মাণে ব্যয় সাড়ে ১১ কোটি টাকা
অনলাইন ডেস্ক

গণপূর্ত বিভাগের তদন্ত কমিটির হিসাব অনুযায়ী ৬টি কক্ষের সিলিং নির্মাণে ব্যয় হওয়ার কথা অর্ধকোটি টাকা। অথচ সে কাজে ব্যয় ধরা হয়েছে সাড়ে ১১ কোটি টাকা। এমন ঘটনা ঘটেছে নোয়াখালী আব্দুল মালেক উকিল মেডিকেল কলেজে। সম্প্রতি দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) অনুসন্ধানে ধরা পড়েছে এমন চিত্র। যার একটি নথি এসেছে এ প্রতিবেদকের হাতে। তবে এ ব্যাপারে কোনো সদুত্তর দেয়নি কলেজ কর্তৃপক্ষ।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে নোয়াখালী আব্দুল মালেক উকিল মেডিকেল কলেজ ভবনের প্রথম ও দ্বিতীয় তলার ছয়টি কক্ষে জিপসাম সিলিং নির্মাণ করে কর্তৃপক্ষ। এ কাজের জন্য নয়টি বিলের অনুকূলে ১১ কোটি ৬৯ লাখ ৭৭ হাজার টাকা পরিশোধ করা হয় ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান নির্ঝরা ট্রেডার্সকে। কিছুদিন পর বিভিন্ন গণমাধ্যমে ওই কাজে অনিয়ম হয়েছে মর্মে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। অভিযোগ ওঠে, বাজারমূল্য থেকে কয়েক গুণ বেশি দাম দিয়ে জিপসাম সিলিং নির্মাণ করা হয়েছে। পরে স্থানীয় গণপূর্ত বিভাগের মাধ্যমে কয়েক দফায় অনুসন্ধান করে দুদক। গণপূর্ত বিভাগের সঙ্গে জিপসাম সিলিং বিষয়ে অভিজ্ঞ এমন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকেও যুক্ত করা হয়। তদন্ত করতে নেমে ব্যাপক অনিয়ম খুঁজে পায় দুদক। অবশ্য তদন্তে সিলিংয়ের সঠিক মাপ, মান সঠিক রয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক তদন্ত কমিটিতে থাকা এক সদস্য জানান, নোয়াখালী আব্দুল মালেক উকিল মেডিকেল কলেজে জিপসাম সিলিং করতে গিয়ে টাকা আত্মসাৎ হয়েছে এমন ঘটনায় গণপূর্ত অধিদপ্তরের নোয়াখালী জেলা কার্যালয়কে তদন্ত করার জন্য চিঠি ইস্যু করা হয়। পরে গণপূর্ত বিভাগ একজন ইঞ্জিনিয়ার ও ডিজাইন এইজ নামে একটি বেসরকারি সংস্থার জিপসামকাজে দক্ষ একজন ব্যক্তির সমন্বয়ে তদন্ত শুরু করে। তদন্তকালীন দুদকের কর্মকর্তারাও উপস্থিত ছিলেন। ঘটনাস্থল পরিদর্শন, কাগজপত্র পর্যালোচনা ও কক্ষগুলো পরিমাপ করে খরচের পরিমাণে ব্যাপক অনিয়ম পান তদন্ত কমিটির সদস্যরা।
তদন্ত প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দেখা যায়, মেডিকেল কলেজ ভবনের নিচতলার ১০৬, ১১৯, ১২১, ১২২ ও দ্বিতীয় তলার ২০৩ নং কক্ষসহ মোট ছয়টি কক্ষে ২০১৬-১৭ অর্ধবছরে জিপসাম সিলিং করার জন্য দরপত্র আহ্বান করে কলেজ কর্তৃপক্ষ। পরে দরপত্র মূল্যায়ন কমিটি যাচাই-বাছাই করে পুনম ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল, এসএল ট্রেডার্স ও নির্ঝরা এন্টারপ্রাইজকে বৈধ দরদাতা বলে বিবেচিত করে। যার মধ্যে পুনম ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল প্রতি বর্গফুট ৬ হাজার ২০০, এসএল ট্রেডার্স ৬ হাজার ৪২৬ এবং নির্ঝরা এন্টারপ্রাইজ ৫ হাজার ৯৫০ টাকা মূল্যে দরপত্র দাখিল করে। তিনটি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে নির্ঝরা ট্রেডার্স সর্বনিম্ন দরদাতা হওয়ায় তাদের কার্যাদেশ দেয়া হয়। ওই কাজের মূল্য বাবদ আব্দুল মালেক উকিল মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. আব্দুছ ছালাম ২০১৬ সালের ১০ আগস্ট থেকে ২০১৭ সালের ৩০ অক্টোবর পর্যন্ত ৬৮২১ নং কোডের বিপরীতে নয়টি বিল বাবদ নির্ঝরা ট্রেডার্সকে ১১ কোটি ৬৯ লাখ ৭৭ হাজার টাকা প্রদান করেন।
তদন্ত প্রতিবেদনের মন্তব্যে বলা হয়, গণপূর্ত বিভাগের ২০১৪ সালের শিডিউল অনুযায়ী ২০১৬-১৭ অর্থবছর সম্পন্ন হওয়া মেডিকেল কলেজের জিপসাম সিলিংয়ের প্রতি বর্গফুট কাজের মূল্য দাঁড়ায় ১৬২ দশমিক ৬৭ টাকা। যার সঙ্গে ভ্যাট ধরা হয় ৫ দশমিক ৫ শতাংশ। কিন্তু বিল পরিশোধের সময় ভ্যাট ধরা হয় ১৫ শতাংশ ও ট্যাক্স বাবদ ৫ শতাংশ। প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, ভ্যাট বাদে প্রতি বর্গফুটের দাম ১৫৩ দশমিক ৭৪ টাকা, আর ২০ শতাংশ ভ্যাট ও ট্যাক্স যুক্ত করলে দর দাঁড়ায় ১৮৪ দশমিক ৪৮ টাকা। এছাড়া লাইট, উন্নত ফিটিংস, আনুষঙ্গিক বিষয়ের সমন্বয়, তৎকালীন বাজারদর ও সিলিং ডেকোরেশন এবং প্রতি বর্গফুট বৈদ্যুতিক কাজের ৩০ টাকাসহ সাকল্যে প্রতি বর্গফুট কাজের মূল্য দাঁড়ায় ২১৪ দশমিক ৪৮ টাকা। অথচ ওই কাজের মূল্য দেখানো হয়েছে ৫ হাজার ৯৫০ টাকা।
মন্তব্যে বলা হয়, ভ্যাট, ট্যাক্সসহ পুরো কাজের খরচ হওয়ার কথা সর্বোচ্চ ৪২ লাখ ৭ হাজার ২৪০ টাকা। কিন্তু খরচ করা হয় ১১ কোটি ৬৯ লাখ ৭৭ হাজার টাকা। যার মধ্যে ভ্যাট ও ট্যাক্সের ২০ শতাংশ বাদ দিলে আত্মসাৎ হয় অন্তত ৮ কোটি ৯৩ লাখ ৭৪ হাজার ৩৬০ টাকা।
তদন্তকাজে সহযোগিতাকারী প্রতিষ্ঠান গণপূর্ত বিভাগ নোয়াখালী কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী সা’দ মোহাম্মদ আন্দালিব বলেন, ‘দীর্ঘ তদন্ত শেষে গত মাসে তার কার্যালয় থেকে দুদক নোয়াখালী জেলা সমন্বিত কার্যালয়কে প্রতিবেদন দাখিল করা হয়েছে।’
এ বিষয়ে আব্দুল মালেক উকিল মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ ও দরপত্র মূল্যায়ন কমিটি সভাপতি অধ্যাপক ডা. আব্দুছ ছালাম জানান, ‘দুদকের অনুসন্ধানে তিনি মৌখিক ও লিখিত জবাব দিয়েছেন। যদি তার অপরাধ খুঁজে পায় রাষ্ট্রীয় বিধান অনুযায়ী যা হবে তাই তিনি মেনে নেবেন।
তদন্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী কী ব্যবস্থা নেয়া হবে—এমন প্রশ্নের উত্তরে দুদক নোয়াখালী কার্যালয়ের উপপরিচালক সৈয়দ তাহসিনুল হক বলেন, ‘ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে মামলার জন্য সুপারিশ পাঠানো হয়েছে।’