অভিযুক্তরা জামিনে মুক্ত বেশির ভাগ ক্ষেত্রে পরিচালকরা ধরাছোঁয়ার বাইরে
ব্যাংক ও আর্থিক খাতে জালিয়াতি

নিজস্ব প্রতিবেদক
গত ১০ বছরে ব্যাংক ও আর্থিক খাতের প্রায় ২৮ হাজার কোটি টাকার অনিয়মের বিভিন্ন ঘটনা নিয়ে অনুসন্ধান করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। অনুসন্ধান শেষে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে প্রমাণ মিললে মামলাও করা হয়েছে। এসব আর্থিক অনিয়মের ঘটনায় ব্যাংক কর্মকর্তাদের দায় মিললেও উদ্যোক্তা বা পরিচালকদের বিরুদ্ধে তেমন কোনো প্রমাণ মেলেনি দুদকের অনুসন্ধানে। হাতে গোনা কিছু ব্যাংকের চেয়ারম্যান বা পরিচালককে দায়ী করা গেলেও তার পরিমাণ খুবই নগণ্য। আবার এসব অনিয়মের মামলায় গ্রেফতারকৃত ব্যাংকারদের প্রায় সবাই জামিন পেয়েছেন। জামিন পাওয়ার পর ফেরার হয়ে গিয়েছেন অনেকেই।
ব্যাংক খাতের বড় ও অত্যন্ত আলোচিত জালিয়াতির শিকার হয়ে প্রায় বন্ধের দ্বারপ্রান্তে চলে গিয়েছিল বেসিক ব্যাংক। এ জালিয়াতির ঘটনায় ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরে ৫৬টি মামলা করেছিল দুদক। এগুলোয় প্রায় সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকার আর্থিক অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ আনা হয়। এসব মামলায় ব্যাংকটির সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক কাজী ফখরুল ইসলামসহ মোট আসামির সংখ্যা শতাধিক। এ অনিয়মের ক্ষেত্রে ব্যাংকারদের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেলেও তত্কালীন চেয়ারম্যান আবদুল হাই বাচ্চুর বিরুদ্ধে কোনো মামলায়ই অভিযোগ আনা হয়নি। যদিও বেসিক ব্যাংকের অনিয়ম ও ধসের জন্য তাকেই দায়ী করা হয় সবচেয়ে বেশি।
আর্থিক খাতের বিভিন্ন জাল-জালিয়াতির অভিযোগে ২০১৬ থেকে ২০২১ সালের জুন পর্যন্ত ১৪২ জনকে বিভিন্ন সময় মামলায় গ্রেফতার করেছে দুদক। তবে তাদের বেশির ভাগই জামিনে রয়েছেন। জেলহাজতে রয়েছেন মাত্র ছয়জন।
বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদের মূল্যায়ন হলো ঋণ জালিয়াতি বা অনিয়মের বিরুদ্ধে মামলাগুলো সঠিকভাবে তদন্ত না হওয়ায় ও সঠিক তথ্যপ্রমাণাদি না থাকায় অভিযুক্তদের অনেকেই ছাড় পেয়ে যাচ্ছেন। তিনি বলেন, অনেক সময় নিরপেক্ষভাবে তদন্ত হচ্ছে না। আবার সঠিকভাবে তথ্য সংগ্রহ করা হয় না। ফলে আইনি ও দালিলিক ঘাটতি থেকে যাচ্ছে। এতে সংশ্লিষ্টরা যেমন আড়ালে থেকে যাচ্ছেন, তেমনি যাদের নাম সামনে আসবে, তারাও ছাড়া পেয়ে যাবেন। সেটি প্রতিরোধ করতে হবে। সেখানে সংশ্লিষ্টদের, বিশেষ করে বাংলাদেশ ব্যাংকের আরো সঠিক তথ্য সরবরাহ করা প্রয়োজন। এছাড়া দক্ষ আইনজীবী দিয়ে মামলা পরিচালনার উদ্যোগ নিতে হবে। মোট কথা আইনের সঠিক প্রয়োগ নিশ্চিত করতে পারলেই আর্থিক খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হবে।
অন্যদিকে দুদকের সাবেক চেয়ারম্যান গোলাম রহমান দায়ী করছেন আইনি কাঠামোকে। তিনি বলেন, পুরো আইনি কাঠামো এমনভাবে করা হয়েছে, যেখানে অনেক ত্রুটি রয়ে গেছে। ফলে যারা প্রকৃত দায়ী, তাদের আইনের আওতায় আনা সম্ভব হচ্ছে না। আবার যাদের ধরা হচ্ছে, তারা ছাড় পেয়ে যাচ্ছেন। অর্থঋণ আদালতে দীর্ঘসূত্রতা রয়েছে। আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো যাতে যাচাই-বাছাই করে ত্বরিত ব্যবস্থা নিতে পারে সে বিষয়ে উদ্যোগী হতে হবে। আবার বিদ্যমান আইনি কাঠামোয় সংশোধনের প্রয়োজন রয়েছে। ব্যাংক খাতে সুশাসন ফিরিয়ে আনতে হলে অবশ্যই ঋণ প্রদান থেকে শুরু করে অনুমোদন পর্যায়ে সবাইকে আইনি কাঠামোর মধ্যে আনতে হবে।
বর্তমানে আর্থিক খাতের বেশকিছু অনিয়মের ঘটনা নিয়ে অনুসন্ধান ও তদন্ত করছে দুদক। এর মধ্যে পি কে হালদারের ১০ হাজার কোটি, বেসিক ব্যাংকের ৪ হাজার ৫০০ কোটি, হলমার্ক গ্রুপের ৪ হাজার কোটি, ক্রিসেন্ট গ্রুপের ১ হাজার ৭৪৫ কোটি ও বিসমিল্লাহ গ্রুপের ১ হাজার ২০০ কোটি টাকা লোপাটের ঘটনাগুলো নিয়ে আলোচনা হয়েছে সবচেয়ে বেশি।
জালিয়াতির মাধ্যমে সোনালী ব্যাংক থেকে প্রায় সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকা বের করে নিয়েছিল হলমার্ক গ্রুপ। এ অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে দুদক বিভিন্ন সময়ে এখন পর্যন্ত ৪০টি মামলা করেছে। এসব মামলায় বিভিন্ন সময়ে বেশ কয়েকজন আসামিকে গ্রেফতার করেছেন দুদকের কর্মকর্তারা। তাদের মধ্যে সোনালী ব্যাংকের কর্মকর্তা আছেন আটজন। এ আটজনের মধ্যে একজন মারা গিয়েছেন। জামিনে রয়েছেন আরেকজন। বাকি ছয় ব্যাংক কর্মকর্তা জেলহাজতে। ব্যাংকিং জালিয়াতির ঘটনায় দুদকের মামলায় গ্রেফতার হয়ে ব্যাংকার জেলহাজতে থাকার ঘটনা বর্তমানে এ একটিই।
বিষয়টি নিয়ে দুর্নীতিবিরোধী প্রতিষ্ঠান ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, অভিযুক্তদের জামিন পাওয়ার আইনি অধিকার রয়েছে। জামিন পাওয়া মানেই অভিযোগ থেকে ছাড় পাওয়া নয়। এক্ষেত্রে অনিয়মের সঙ্গে জড়িতদের বিচারের পথ যেন বন্ধ হয়ে না যায় সে বিষয়ে শক্ত পদক্ষেপ নিতে হবে। দুদক অনুসন্ধান তদন্ত প্রতিবেদনের মাধ্যমে অপরাধীকে যাতে বিচারের মুখোমুখি করতে পারে, সে বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে।
নাম অপ্রকাশিত রাখার শর্তে দুদকের কয়েকজন কর্মকর্তা বলেন, অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে মামলার পরিপ্রেক্ষিতে অভিযুক্ত ব্যাংক কর্মকর্তাদের গ্রেফতার করা হয়েছে। এক্ষেত্রে বলা যায়, ব্যাংকের যেসব কর্মকর্তা দুর্নীতিবাজ তাদেরই গ্রেফতার করা হয়েছে। দুদক একটি স্বাধীন সংস্থা হলেও এর অনেক সীমাবদ্ধতা রয়েছে। জনবল সংকট নিয়েই সংস্থাটিকে কাজ চালাতে হচ্ছে। উপরন্তু আর্থিক অনিয়মের ঘটনাগুলোয় তদন্ত করতে গিয়ে সংশ্লিষ্ট অন্যান্য সংস্থার সঙ্গে সমন্বয়হীনতা ও সীমাবদ্ধতার কারণে অনেকেরই দুর্নীতির অভিযোগ প্রমাণ করা অসাধ্য হয়ে যায়।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে দুদকের পক্ষের আইনজীবী খুরশীদ আলম খান জানান, অনেক সময় অনুসন্ধান তদন্ত শেষ হতে সময় লাগে। আবার বিচারিক প্রক্রিয়াও একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়া, সেখানেও সময় লাগে। এর পরও ব্যাংক খাতের অনিয়ম শনাক্তে ও অভিযুক্তদের শাস্তির আওতায় আনতে দুদক তত্পর।
গত বছরের ডিসেম্বরে উচ্চ আদালতে আড়াই হাজার কোটি টাকার অর্থ পাচারের ঘটনার তথ্য দেয় দুদক। এর মধ্যে শুধু ক্রিসেন্ট গ্রুপের প্রতিষ্ঠানগুলোই ১ হাজার ৭৪৫ কোটি টাকা পাচার করেছে বলে উল্লেখ করা হয়। সে হিসেবে ক্রিসেন্ট গ্রুপের অর্থ পাচারের ঘটনাগুলোকেই বিদেশে অর্থ পাচারের সবচেয়ে বড় ঘটনা হিসেবে দেখছে দুদক। কমিশনের নথি অনুযায়ী, ক্রিসেন্ট গ্রুপের রূপালী কম্পোজিট লেদারওয়্যার, ক্রিসেন্ট ট্যানারিজ, লেক্সকো লিমিটেড, ক্রিসেন্ট লেদার প্রডাক্টস ও রিমেক্স ফুটওয়্যারের মাধ্যমে বিদেশে এ টাকা পাচার করা হয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান হিসেবে এমএ কাদের ও এমএ আজিজ দুই ভাই চিহ্নিত হয়েছেন অর্থ পাচারের মূল হোতা হিসেবে।
ক্রিসেন্ট গ্রুপের প্রতিষ্ঠানগুলোর এসব অর্থ পাচারের ঘটনায় এ পর্যন্ত পাঁচটি মামলা করেছে দুদক। কমিশনের তদন্তসংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, বর্তমানে সবক’টি মামলার তদন্তকাজ চলছে। বেশকিছু কাজ গুছিয়ে আনা হয়েছে। তদন্তে পাচার করা অর্থের আরো খোঁজ মিলেছে। সেসব বিষয়ে তথ্য সংগ্রহের কাজ চলছে।
বিষয়টি নিয়ে দুদক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মঈনউদ্দীন আবদুল্লাহ জানান, কমিশন যেকোনো অভিযোগই সমান গুরুত্ব দিয়ে অনুসন্ধান করে। ব্যাংকের উদ্যোক্তা বা পরিচালকদের ছাড় দেয়ার কোনো সুযোগ দুদক বিধিতে নেই। যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণ হবে, তাদের বিরুদ্ধেই দুদক আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবে।